তিলকের বন্ধুটিও কম স্মার্ট নয়। তিলকের বৌয়ের দিকে তাকিয়ে সে বলে, কী ব্যাপার? আমার বৌ-ই বুঝি এ বাড়ির প্রধান অতিথি? আমি আর কেউ নই? আমায় বসতে বলনি তো?
তিলকের বৌ ব্যস্ত হয়ে বলে, বসুন, বসুন। এক যাত্রায় পৃথক ফল, তা কি হতে পারে?
গোঁফ মুচড়ে তিলকের বন্ধু আয়েশ করে বসে। তিলকের দিকে তাকিয়ে বলে, জানিস তো বেশিদিনের অদর্শনে সম্পর্কটা জোলো হয়ে যায়।
তিলকের বৌ বলে, তাই নাকি। আমার তো মনে হয়, সম্পর্কটা আরো গাঢ় হয়। আমাদেরই দেখুন না, রোজকার এই মাজাঘষা জীবনে…। তিলকের বৌ আরো কী বলতে চায়। কিন্তু তিলক কড়া চোখে একবার তাকিয়েই বৌকে থামিয়ে দেয়। তিলক ভাবে, এই মুখরা স্ত্রীলোকদের জন্যেই সংসারে যত অঘটন। ওর বন্ধু-পত্নী তখন ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাড়ি দেখছে। গোটা বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখে এসে তিলকের একদা প্রেমিকা বলে, যা একখানা বাড়ি করেছে, দারুণ!
তিলক খুশি হয় না। ওর মুখটা ব্লটিং পেপারের মতো চুপসে যায়। সেই মুহূর্তে ওর চোখ চলে যায় ঘরের ফাটা দেওয়ালের দিকে। চুইয়ে চুইয়ে বৃষ্টির জল পড়ছে। এক বছরও হয়নি বাড়ির বয়স। এরই মধ্যে দেওয়াল ফেটে চৌচির। সিমেন্টে ভেজাল। কন্ট্রাকটর পয়সা মেরেছে। তিলক ভাবে সত্যিই কি প্রশংসা করল নাকি ওটা ওর শ্লেষ? তিলক কিছুই বলে না চুপ করে থাকে। ওর বৌই বলে, বাড়ির মালিক যদি মিষ্টি হয়, তবে ফাটা বাড়িও মিষ্টি কী বল?
কোয়দায় পড়ে তিলক ভেতরে ভেতরে জ্বলতে থাকে। সেই বেকায়দা অবস্থা থেকে ওকে অবশ্য উদ্ধার করে ওই একদা প্রেমিকাটিই। সে বলে, বাড়ির মালিক মিষ্টি না টক, ঝাল, তেতো সে ভাই যে ঘর করে সে বোঝে। মিষ্টি হলেই বা, মিষ্টির ভাগটা তার ভাগ্যে জোটে কি?
তিলকের বন্ধু বলে, চ্যাপ্টারটা এখন বন্ধ করলে হয় না? —সে তার স্ত্রীর দিকে তাকায়। তিলক তাড়াতাড়ি বৌকে বলে, যাও যাও চটপট চা করে নিয়ে এস। লাহিড়ীর গিন্নি একেবারে ভিজে ফিজে গেছে।
তিলক সহজভাবে ওদের দিকে তাকায়। কিন্তু তিলকের বৌয়ের বুকে কথাটা ধ করে বাজে। তিলকের বৌ ভাবে, আহা, সে কি এ বাড়ির দাসী বাঁদি? লাহিড়ী গিন্নির জন্যে চা করতে যাবে? তিলকের বৌ তাই সঙ্গে সঙ্গেই নড়ে না। উল্টে তিলককে বলে, তুমি যাও তো চটপট বাজারটা সেরে ফেল। চায়ের ভাবনা তোমায় ভাবতে হবে না। তারপরই তিলকের বৌ অদ্ভুত এক কাণ্ড করে ফেলে। সে খপ করে লাহিড়ী গিন্নির হাত চেপে ধরে গলায় মধু ঢেলে বলে, এসো ভাই, কাপড়টা ছেড়ে ফেলো।
অপ্রস্তুত লাহিড়ী গিন্নি বলে, আমার কিছু অসুবিধে নেই। সিনথেটিক শাড়ি। হাওয়ায় দিব্যি শুকিয়ে যাবে। কথাগুলো বলেই লাহিড়ীর বউ উঠে দাঁড়িয়ে। ফ্যানের রেগুলেটারের গতিটাকে বাড়িয়ে দেয়। শাড়ির আঁচলটা ছড়িয়ে ধরে পাখার নিচে। সময়টা বর্ষাকাল হলেও শীতকাতুরে তিলক খক খক করে কাশে। এতক্ষণে ওদের দুজনেরই খেয়াল হয়, তিলকের গায়ের চাদরটার দিকে। লাহিড়ীর বউ হেসে বলে, কী ব্যাপার? আপনার গায়ে কি দার্জিলিঙ পাহাড়?
তিলক লাজুক লাজুক হাসে। তিলকের বউ বলে, ওর তো সব সময় শীত শীত বাকি।
লাহিড়ীর বউ অন্যমনস্কভাবে বলে, জানি?
তিলকের বউ আড়চোখে তাকিয়ে বলে, জানো?
তিলক সপ্রতিভভাবে কথাটা ঘুরিয়ে দিয়ে বলে, হ্যাঁ, পূর্বজন্মের স্মৃতি থেকে।
তিলকের বন্ধু লাহিড়ী বলে, তোমরা আপাতত পূর্বজন্মের স্মৃতিচারণ কর। আমি একটা সিগারেট ধরাই।
লাহিড়ীর কথায় সবাই হেসে ফেলে। তিলকের বউ উঠে দাঁড়ায়। এবার সত্যি সে চা করতে যায়। বউয়ের পেছন পেছন তিলকও যায় রান্নাঘরে। তিলক গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলে, কিগো শুধু চা-ই দেবে? কিছু আনতে টানতে হবে না?
তিলকের বউ কোনো জবাব দেয় না। গুম হয়ে থাকে। তিলক নরম গলায় আমতা আমতা করে, মানে ওরা ভিজে টিজে এল তো? আর অদ্দিন বাদে এল, তাই বলছিলাম, গরম চপটপ…।
তিলকের বউ ফোঁস করে ওঠে, এই না বাজার করার নামে তোমার জ্বর এসেছিল?
তিলকের আর দ্বিতীয় কথা বলা হয় না। ও কেন্নোর মতো গুটিয়ে যায়। তিলক ভাবে, ধিক্ তার পুরুষ জন্ম। এই রকম চল্লিশ ইঞ্চি বুকের ছাতি নিয়েও বউয়ের বিনা
অনুমতিতে ভূতপূর্ব প্রেমিকার জন্য কিছু খাবার দাবার আনার সাহস নেই তার? গোমড়া মুখে ফিরে গিয়ে বাইরের ঘরেই বসে তিলক। ভিজে কাপড়ের মধ্যে থেকে ভুরভুর করে বন্ধু-পত্নীর গায়ের মিষ্টি গন্ধ। তিলক সাবধানে টেনে নিঃশ্বাস নেয়। চোরের মতো চেয়ে দেখে বন্ধু পত্নীকে। লাহিড়ীর বউ আরও গোলগাল হয়েছে। তিলক চাপা নিঃশ্বাস ছেড়ে ভাবে, এই পুরুষোচিত বিশাল শরীরটা নিয়েও সে মেয়েমহলে ভিতুই থেকে গেল? শুধুমাত্র অধিকার প্রয়োগের অভাবে সে এই মেয়েটির জীবনসঙ্গী হতে পারল না
তিলকের বউ খানিকবাদে চা নিয়ে আসে। অন্য প্লেটে চানাচুর। কিছু পকৌড়াও ভেজে এনেছে বউ। তিলক অবাক হয়। তিলককে আরও অবাক করে দিয়ে বউ বলে, বিষ্টি ফিষ্টি পড়ছে, আমাদের সঙ্গে আজ দুটো খিচুড়ি হয়ে যাক না?
কথাটা ছুঁড়েই সে তিলকের দিকে তাকায়। তিলক বোঝে, বউ ওকে টেক্কা দিতে চায়। তিলকের হয়তো খুশি হওয়াই উচিত ছিল। লাহিড়ী আর লাহিড়ীর বউ কিছু বলার আগেই তিলক তাড়াতাড়ি বলে, হ্যাঁ, ওদের বয়েই গেছে তোমার খিচুড়ি