- বইয়ের নামঃ পিঞ্জরে বসিয়া শুক
- লেখকের নামঃ কমলকুমার মজুমদার
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. সুঘরাই হারাইয়া যায়
জয় মাধব, তারা ব্রহ্মময়ী, মাগো–জয় রামকৃষ্ণ
তখনই যে সময়ে সুঘরাই হারাইয়া যায় এই দিব্যমাল্য সাজান, ভাস্বর, হীরক-শোভাতে বিনিদ্র শহরে–ইহা শিবপুরী, ভক্ত ও মুক্তি প্রদায়িনী যাহা, সৌন্দৰ্য্য যাহা, যে শহর, তখনই সে আপনকার সীমা বুঝিয়া তীব্র আতান্তরে পড়িয়াছিল; যে তাহার শেষ অঙ্গুলিশীৰ্ষতেই ও অন্য প্রত্যঙ্গাদিতে যে ইহার পর হইতেই এবং বনস্থলী চমকপ্রদ হইয়া রহে, যে ইহার পর হইতেই দীপের জ্যোতির্ময়ী ঘটনার প্রবাহ! যে ইহার পর হইতেই আমি, হায়! আমি নারসিসস্-রে পথিক করিয়াছি।
ঐ সীমা ভাবিয়া, ও আমার মনিব! ও আমার মনিব! বলিয়া সে বড়ই উভরায় কান্দিয়া থাকে ইহা সত্য, অথচ আদতে তাহাতে প্রচ্ছন্ন ছিল কূট বিদ্বেষজনিত ক্রোধ, সে যেমন সেই সাধক–যে যিনি নির্ভীক তোয়াক্কাহীন দামাল, আকৰ্ণবিস্তৃত নেত্র যাঁহার হিঙ্গুল, চেহারা যাঁহার বৈরাগ্যসুন্দর দশাসই, গাত্র যাঁহার মসৃণ ও উজর তাম্রবর্ণের, যাঁহার পরনে কৌপীন, হস্তে যাঁহার সুমহৎ চিমটা; এখন যিনি এই লোকপ্রসিদ্ধ মন্দিরের দরজার চৌকাঠেতে অদম্য দুঃসাহসে ভীষণ রাগে ঐ চিমটা দ্বারা বারম্বার আঘাত করিতে উন্মাদ; ইহাতে ক্রমান্বয়ে তদীয় স্কন্ধ বলীবৰ্দের প্রায় স্ফীত হইতেছিল, ঘৰ্ম্মে তাঁহার কপালের হোমতিলক ঘুণাক্ষরে পরিণত হইল, হঁহার রুদ্রাক্ষমালা আন্দোলিত, আর যে তিনি মুহুর্মুহুঃ বীরবিক্রমে ত্রিভুবনের ত্রাসসঞ্চারী হুঙ্কার পাড়িতেছিলেন।
ঐ বিপুল হুঙ্কারমধ্যে ঐ অভিনব সাধক জলদগাম্ভীর্যে মা ভৈঃ উচ্চারণ করিয়াছিলেন, আবার কখনও বা ভগবান শিবকে বিকট আঁশটে বচনে গালি ও টিট্টিকার দিতে থাকিয়া ইহাও বলিতেছিলেন, শালা…অদ্য আমারে দর্শন দিতে হইবে, আমি কণ্ঠে ফিরিয়া আসিতে চাহি না, দে শালা অখণ্ডতা!
যে এবং ঐ সাধক এরূপ অহঙ্কারও প্রকাশ করেন, যে, আমি তোমার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করিয়াছি…আর তুমি আমাকে ফাঁকি দিবে!
.
ঈদৃশ নানান অর্থপূর্ণ শব্দের সহিত চিমটা-প্রহারের সঘন আওয়াজ হইতে থাকিল, আশ্চৰ্য্য যে ইহাতে কুকুর ও পাখীরা রব তুলে নাই, নিকটে থাকিয়া সুঘরাই কিছু আড়ষ্ট, কিছু কৌতূহলী!
সে দেখিল, অনেক পূজার্থী ও ধার্মিকরা ঐ বীরের সমীপস্থ হইয়া বিস্ফারিত লোচনে, তাঁহার ঐ ভয়ঙ্কর উদ্ধত ক্রিয়াকলাপ দেখিতে থাকিয়া ভক্তিবিহ্বল হৃদয়ে, কেহ বা অশ্রু ভারাক্রান্ত ইতিমধ্যেই, অহরহ, অহরহ ‘জয় বৈদ্যনাথ শিবশম্ভ’ ধ্বনি দিতেছিলেন; তাই ইদানীংকার সমস্ত ভাবে আমাদিগের জীবন এক সুউচ্চ মহিমার অবস্থায়ে স্থায়ী হইয়াছিল।
সাধক ঘোর দম্ভে পুনরায় ঘোষণা করিলেন,…আমি মন্দিরে যাইব না…তুমি স্বরূপে আসিয়া দেখা দাও…। এবং যে ইহার পরক্ষণেই তদীয় বিপুল দেহ ভাঙ্গিয়া পড়িল, তিনি চেতনশূন্য হইলেন; তখনই, সমবেত প্রত্যেকে তাহার অবলোকনে মহা গৌরবান্বিত বোধ করিলেন; ইহারা সশ্রদ্ধচিত্তে, মন্থরে, শিব ধ্বনি তুলিতে থাকিয়া ও তৎসঙ্গে ঐ সাড়হীন দেহের উদ্দেশে পুষ্পমাল্য আদি বর্ষণ করিতে গৌরবান্বিত বোধ করিলেন; ইহারা সশ্রদ্ধচিত্তে, মন্থরে, শিব ধ্বনি তুলিতে থাকিয়া ও তৎসঙ্গে ঐ সাড়হীন দেহের উদ্দেশে পুষ্পমাল্য আদি বর্ষণ করিতে সময়ে, ইহা বলিলেন,…হে নীলকণ্ঠ, হে ভগবান উমাপতি, তুমি অন্তর্যামী, আমাদের পুরুষানুক্রমে এবং পূৰ্ব্বজন্ম ও ইহকালের জন্য আমাদের যে অমরতা বরাদ্দ আছে…তাহা অচিরেই ঐ সাধকেরে দেওয়া হউক, কেন না তুমি তাহার (ঐ সাধকের) অবিনাশী প্রেম।
সাধকের অন্তর্দশা প্রাপ্ত দেহটির শুশ্রূষাকরণে অতীব শুদ্ধাচারী ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেহ সাহস পর্যন্ত করেন না, এই জন্য যে ঐ পাঞ্চভৌতিক দেহ অধুনা কৃষ্ণাচতুর্দশীর পরমাশ্চৰ্য্য চন্দ্রকলা! এখন কেহ সাধকের কর্ণে অমৃত শিব নাম, কেহ ব্যজন, কেহ উহার মেরুদণ্ডে ঘৃত কর্পূর মালিশ করিতেছিলেন, অনেকক্ষণ পর সাধক খানিক সহজ অবস্থায় আসিলেন ও তাবিজড়িত স্বরে কহিলেন, জল…জল খাইব!
এইভাবে ইহজগতের সহিত সম্পর্ক গঠিত হইল।
সুঘরাই এহেন প্রহেলিকার কিছু, সরলতার এতটুকুন, বীরত্বের লেশমাত্র না বুঝিয়া শুধু সাধকের দুর্ধর্ষতা গ্রহণ করিয়াছিল। আর যে তেমন তেমন রোষে সেও জ্বলিতেছিল–সম্ভবত, কেন না তাহারই ছায়া বাঁচাইতে ব্রাহ্মণ্য শ্রীসম্পন্ন পাণ্ডাঠাকুর মহাশয় ঈষৎ দিভ্রান্ত হওয়ত স্বীয় উড়নীতে সামাল দিয়াছিলেন; বিশেষই নিশ্চিত, কেন না সে বেচারী মন্দিরের দুয়ারের এই পার্শ্ববর্ত্তী স্থান ত্যাগে বাধ্য হয়। তখনই, যখন ঐ সাধক অন্তর্হিত হইয়াছেন, যখন এরূপ সুদুর্লভ পবিত্রতার অর্থাৎ মন্দিরের নৈকট্যে আসাতে যে এক অনির্বচনীয় আহ্লাদে তাহাতে গোঁয়ার হইয়া উঠিয়াছে!
এবং তাই তৎক্ষণাৎ সুঘরাই, তদীয় স্নেহশীলা মনিব পত্নী আদিষ্ট, সেই মনোলোভা সার্থক কামনা জানাইতে পারে না। যে পরম ভক্তিমতী রমণী যে সূত্রে বলিয়াছিলেন,…এখন বাবা বোদ্দিনাথের ইচ্ছে যদি হয়, এমন যদি করেন, তুই তাঁর সামনে একেবারে…উঃ তাহালে! হ্যাঁরে তেমনতারা ভাগ্য কি আর ছোঁড়া তুই করেছিস!…সে নয় নাই হ’ল…তবু তুই দাঁতে দাঁত দিয়ে…জা যায় সেও ভি আচ্ছা, তুই তাঁকে ডাকবি, দেখবি তোর পাপ তিনি মুছে দেবেন!