–মুশকিল! জানা উচিত ছিল। দ্যাখো দেখি, এই দুর্দিনের বাজারে…।
তিলকের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ওর বৌ বলে, তোমার মায়ের তাহলে মেয়ে দেখতে যাবার সময় বলা উচিত ছিল, তুমি সস্তার রান্না কী শিখেছ মা? তা না বলে, উনি তো আমায় পোলাও, কালিয়া, চিংড়ির মালাইকারির রেসিপি জিজ্ঞেস করেছিলেন? ছেলের ক্ষমতার কথাটা ভেবে সস্তার রান্নার রেসিপি জিজ্ঞেস করলেই পারতেন?
বৌয়ের কাছে মুখ ঝামটা খেয়ে তিলক চুপ করে যায়। এমন সুন্দর বর্ষার সকাল! কোথায় রসের কথা বলবে তা নয়। কী ঠিকুজি মিলিয়েই না মা বিয়ে দিলেন আহা! কিন্তু সেই বা কম যাবে? তিলক বলে, ওসব রান্নার রেসিপি জিজ্ঞেস করলেই তুমি পারতে? এমন একটা ভাব দেখাচ্ছ যেন কোনো হাই ফাই ঘর থেকে আসছ তুমি।
তিলকের বৌ বলে, তাহলে কী আর তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হত?
–সক্কালবেলা তুমি কি থামবে? তিলকের বৌ বলে, তুমি যত জোরে চ্যাঁচাবে, আমিও ততজোরে চ্যাঁচাব। তিলক বলল, তা আর চ্যাঁচাবে না? জ্যোতিষীকে দিয়ে ফলস্ কুষ্ঠি করে তো তোমার মা বিয়ে দিয়েছিলেন।
তিলকের বৌ চোখ কপালে তুলে বলে, আর তোমার মা বুঝি ধোওয়া তুলসী পাতা? উনি যাননি পঞ্চানন জ্যোতিষীর কাছে তাঁর ছেলের নতুন কুষ্ঠি করতে?
তিলক বলে, গিয়েছিলেন নিশ্চয়। যেমন তোমার মা গিয়েছিলেন।
—এই খবরদার আমার মা তুলে কথা বলবে না বলছি। অত ছোট কাজ আমার মা করেন না বলছি।
আমার মা-ই বুঝি করেন? —তিলক চেঁচিয়ে বলে, তিলকের বৌ ততোধিক চেঁচায়। উনি স্বর্গে গেছেন। ওঁকে নিয়ে আর কথা বাড়াতে চাই না। তোমাদের পরিবারের নাড়ি নক্ষত্র আমার জানা।
বৌয়ের সঙ্গে তর্কে তিলক একেবারেই পেরে ওঠে না। ও দারুণ রেগে যায়। ও পাঞ্জাবির পকেট বাজিয়ে বলে, তোমার মা, বাবা কি খোঁজ খবর না নিয়েই বিয়ে দিয়েছিলেন? আমার অফিসে যান নি খবর নিতে? আমি রিটায়ার করলে কত পাব, না পাব, একেবারে ক্যালকুলেশন করেই না ওঁরা…।
—থামো, থামো। —তিলকের বৌ বলে, তোমার মা বড়ো গলা করে বলেছিলেন, বিয়ের পরই নাকি তুমি ফরেন চলে যাবে?
–ফরেন? —তিলক কপালে চোখ তোলে। বলে, একথা আবার কে বলল?
তিলকের বৌ চোখ ঘুরিয়ে বলে, কে আবার বলবেন? তোমার মা-ই বলেছিলেন।
তিলকের মেজাজ এবার সত্যি চড়ে যায়। ও দুহাত অস্থিরভাবে চুলের মধ্যে চালাতে চালাতে বলে, বাজে বকবে না বলছি। একদম বাজে বকবে না। আমার মায়ের তো আর মাথা খারাপ হয়নি? তিলকের বৌ বলে, মাথা খারাপ কেন হবে? একেবারে সুস্থ স্বাভাবিক মাথাতেই বলেছিলেন উনি।
–দ্যাখো, আমার মায়ের নামে মিথ্যা বলবে না বলছি।
তিলকের বৌ কপালে হাত ছুঁয়ে বলে, ছিঃ! মিথ্যে বলব কেন? উনি স্বর্গে গেছেন। ওঁর নামে কি মিথ্যে বলতে পারি? তিলক কোনো কথা বলে না। ও গম্ভীরভাবে বারান্দায় মোড়ার ওপর বসে বসে পা দোলায়। ওর মা যদি এখন বেঁচে থাকতেন? ও সোজা গিয়ে চেপে ধরত ওঁকে। মায়ের স্বভাবই ওই ছিল, ছেলের
মতা থাক বা নাই থাক, বানিয়ে বানিয়ে তিলকে তাল করা। বিয়ের বাজারে ছেলের নাম তো বাড়ালেন, এখন ঠেলা সামলাবে কে?
তিলককে জব্দ করতে পেরে তিলকের বৌ মহা খুশি। আড়চোখে সে স্বামীকে রিপ করতে করতে বলে, তোমার মা অবশ্য মিথ্যে বলেন নি। সত্যি তো ফরেন গিয়েছিলে তুমি। বাংলাদেশ যাওনি—কথাগুলো বলেই ও মুখ টিপে হাসে।
অপমানে তিলকের মুখ লাল। সে আগুন চোখে স্ত্রীকে দেখে। তারপরই চেঁচিয়ে ওঠে, থামবে?
ঠিক সেই সময় গেট খুলে কারা যেন হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে। তিলক একগাল হেসে বলে, একেবারে কাকভেজা হয়ে যে। আরে এসো, এসো।
তিলকের বৌ পর্দা সরিয়ে বলে, ওমা, তোমরা? বোসো, বোসো।
তিলক ত্যারছা চোখে স্ত্রীর দিকে তাকায়। আগন্তুক মহিলাটির চোখে মুখে হাসির বান। বলে যাক, চিনতে পারছ?
তিলকের বৌ বাঁকা হাসি ছুঁড়ে বলে, কী যে বল? ও মুখ কি ভোলবার? তিলক বিরক্ত হয়, বৌয়ের ব্যঙ্গে। মহিলা তিলকের পূর্ব প্রেমিকা। বর্তমানে বন্ধুপত্নী। ওদের প্রেম যদিও বেশিদূর এগোয় নি। এই আড়ে আড়ে চাওয়া, কথার পৃষ্ঠে দু একটা কথা। ছোঁড়া। লুকিয়ে চুরিয়ে দূর থেকে চোখাচোখি। পয়লা বৈশাখের সকালে শুভেচ্ছা জানানোর ছলে একে অন্যকে রক্ত গোলাপ দেওয়া। হাতে হাত ছুঁইয়ে প্রেমের প্রতিশ্রুতি। এই আর কী। কিন্তু সেই পূর্বরাগের পালা চলতে না চলতেই মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পরই তিলক আবিষ্কার করে, ওরই এক বন্ধু ওর প্রেমিকার স্বামী।
সেই সব গল্পই দুর্বল মুহূর্তে তিলক করেছে বৌয়ের কাছে। ব্যস, আর যায় কোথায়? উঠতে বসতে সেই খোঁটা।
বন্ধু-পত্নী এলেই তিলক আজকাল খুব স্মার্ট হবার চেষ্টা করে। বুকের ভেতর পাথর চাপা যন্ত্রণা নিয়েও তিলক হাসিমুখে ওদের অভ্যর্থনা জানায়। এখন তিলক ঠোঁটে একটা সিগারেট গুঁজে বন্ধুর দিকে আর একটা এগিয়ে দেয়।
সহাস্যে বন্ধু-পত্নীকে বলে, তারপর? অ্যাদ্দিনে মনে পড়ল? এ রাস্তা দিয়ে কি আর হাঁটা টাটা হয় না? বন্ধুপত্নীও কলকল করে ওঠে, আমাদের বাড়িটাই কি খুব বেশি দূরে? মনে আছে নিশ্চয়?
তিলক উত্তর দেবার আগেই ওর বৌ বলে ফেলে, না না, এত তাড়াতাড়ি ভুল হবার নয়। তিলক শ্যেনদৃষ্টিতে বৌয়ের দিকে তাকায়। এতদিন বাদে দেখা, কিন্তু এভাবে বাগড়া দিলে কি কথা জমে? বৌয়ের মুখ নাড়া খেয়ে যে তিলক শামুকের খোলের মধ্যে গুটিয়েছিল, সেই তিলকই এখন একটু একটু করে বেরিয়ে আসে। তিলক ভাবে, এই বিবাহ শব্দটার মধ্যেই যত গণ্ডগোল। বিয়ে ফিয়ে না করলে তো দিব্যি বন্ধু-পত্নী টীদের নিয়ে চালিয়ে দেওয়া যেত।