- বইয়ের নামঃ টেককা টেককি
- লেখকের নামঃ কণা বসুমিত্র
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
টেককা টেককি – কণা বসুমিত্র
ঠাণ্ডায় জবুথবু হয়ে চাদরটা গায়ে জড়িয়ে বসেছিল তিলক। ওর চোখের সামনে দিয়ে সকাল ফুরিয়ে যাচ্ছে। রোববার অথচ বেরোতে পারেনি। এই রোববারের সকালটাই সব থেকে দামি মনে হয় তিলকের কাছে। অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। সামনের রাস্তাটায় রীতিমতো জল দাঁড়িয়ে গেছে। আকাশ এখন মেঘলা। তিলক শীতকাতুরে হলেও শীত ভালবাসে। গরম মোটেই সহ্য হয় না ওর। লোডশেডিংয়ের দাপটে প্রায়ই ও সদিগর্মিতে ভোগে। অসহ্য গরমের পর সবে বর্ষা নেমেছে। সেই সঙ্গে ঝোড়ো বাতাস। তিলক বারান্দায় বসে হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে বাগানের আমগাছের ডালে কাকের বাসা দেখছে। কদিন ধরে ঠোঁটে করে খড়কুটো এনে কাকটা দিব্যি বাসা বানিয়েছে। তারপর ডিম পেড়েছে। এখন যত্ন করে সেই ডিমে তা দিচ্ছে। ঝড়ের বেগে সব ডালপালা তখন ওলোট পালোট খাচ্ছে, কাকটা অসহায় ভীত চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তিলক ভাবে, কাকটাকে যদি ও সাহায্য করতে পারত।
ওদিকে তিলকের বউ রান্নাঘর থেকে তখন হাঁক পাড়ছে, কি গো বাজার টাজার যাবে না?
তিলকও চেঁচায়, এই জল কাদায় যাই আর কি? খিচুড়ি আলু-পেঁয়াজ ভাজা আর ডিমভাজা করে দাও। ফার্স্ট ক্লাস। আজ তো খিচুড়ি খাবার দিন।
তিলক একেই কুঁড়ে। বাজারে যেতে চায় না। তারপর আবার বৃষ্টি হওয়ায় পোয়া বারো। কিন্তু বৌয়ের হাত থেকে কি আর রেহাই আছে? তেড়ে আর এক চোট বৃষ্টি নামে। তিলক মনে মনে খুশি হয়ে একটা সিগারেট ধরায়।
তিলকের বৌয়ের গলা শোনা যায় রান্নাঘরে। তিরিক্ষি মেজাজে কী নিয়ে যেন ঝিয়ের সঙ্গে চঁচামেচি করছে। তিলক জানে, আসল ঝালটা তিলকের ওপরেই ঝাড়ছে। ঝি উপলক্ষ্য মাত্র। তু তিলক নট নড়ন চড়ন।
ওর চোখের সামনে উঠোনের ওই প্যাঁচপেচে কাদা। আমের ডালটা যদি ভেঙে ওর মাথায় পড়ে?
তিলক মরলে বৌ বড়োলোক। কথাটা ভেবেই চাপা রাগে দাঁত কিড়মিড় করে তিলক। তিলকের বৌ কাপড়ে হলুদ মুছতে মুছতে ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। হাত নেড়ে বাজখাঁই গলায় বলে, শুধু চালে ডালে চড়িয়ে দিলেই হবে? নুন আনবে না? পেঁয়াজ আদা লঙ্কা? ডিমভাজা, আলু ভাজার ফরমাশও তো আছে?
তিলকের মাথায় ধাঁই করে বেজে ওঠে পেঁয়াজ শব্দটা। তিলক ব্যঙ্গ মেশানো। গলায় বলে, আমাদের বাড়ি বাপু পেঁয়াজ টেয়াজ চলত না। পেঁয়াজ, মুরগি, এসব শব্দগুনো তুমি আসার পরই আমদানি…। তিলকের বৌ তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে।
–কী কী বললে? আমি এসে? আমি এসে তোমার জিভের স্বাদ বাড়িয়েছি। বল? জানতে কিছু? পেঁয়াজ ছাড়া কি মশুর ডালের পাতলা খিচুড়ি হয়? পেঁয়াজ টমেটো..? এতদিন তো শুধু খেয়েছ তোমরা মুগডালের খিচুড়ি।
তিলক হেসে বলে, মুগডালের খিচুড়িতে কেমন পুজো পুজো ভাব বল তো?
–কী, কী বললে?
তিলক বিড়বিড় করে বলে, ড্যামভ্যান উইল।
–কী বললে?—এবার তিলকের বৌয়ের গলার স্বর আরও চড়া। তিলক কথা ঘুরিয়ে মুচকি হাসে। বলে, বলছিলাম ভোগের খিচুড়িই হোক না আজ।
তিলকের বৌ চোখ বড়ো বড়ো করে বলে, বললেই হল? কোথায় তোমার গরম মশলা ঘি নারকেল,পেস্তা বাদাম কিশমিশ?
তিলক বৌয়ের ফর্দ শুনে আঁতকে ওঠে।–এসব তোমার স্টকে নেই?
–কী করে থাকবে? বাজার যাও কদিন?
—তুমিও তো যেতে পার। তুমি তো বাপু পর্দানসীন যুগের বালিকা বধুটি নও?
–নই। কিন্তু কেন যাব? তুমি রান্নাঘরের হেঁসেলটি ধরবে? আজকাল তো ফিফটি ফিফটির যুগ, তাই না? দুজনেই দুজনের কাজ সমান ভাবে ভাগ করে নেব।
—বেশ, তুমি তবে অফিস যাও?
–অফিস তো যেতুম। চাকরিটা ছাড়িয়ে দিলে কেন? হেঁসেলটা ধরার জন্যে নয়?
—যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে।
–এখন একথা বলছ, কিন্তু সেদিন? আমি তো তাই চেয়েছিলুম?
কথা চলে যাচ্ছে অন্যদিকে। অশান্তির ঝড় উঠবে। তিলক চট করে বলে বসে, বৌ ট্রামে, বাসে, ঠেলাঠেলি তোণ্ডতি খেয়ে চাকরি করতে যাবে, আর আমি তাই বসে বসে দেখব?
—ওসব ছাড়ো, ঢের হয়েছে আদিখ্যেতা। এবার ভোগের খিচুড়ি না কী বলছিলে, তাই বল?
তিলক বলে, কী বলব? ঘরে কি মুগডাল, গোবিন্দভোগ নেই? নারকেল, কাজুর দরকার কী? আমার মাও তো খিচুড়ি করতেন!
তিলকের বৌ বলে, কী বললে। তোমার মা ঘি গরমমশলা পেস্তা ছাড়া ভোগের খিচুড়ি করতেন কী করে? ভোগের খিচুড়ি বলতে আমরা তাই বুঝি গো। তোমাদের বাড়ির সঙ্গে আমাদের বাড়ির ঘরানার এটাই ফারাক। আমি বনেদি বাড়ির মেয়ে বুঝলে? কথাগুলো বলেই তিলকের বৌ ব্যঙ্গের হাসি হাসে।
বৌয়ের কাছে হেরে গিয়ে তিলক মনে মনে লজ্জা পায়। কারণ, তিলক জানে, ওর বাপের বাড়ির গল্পের এখানেই শেষ নয়। তিলক তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ভোগের খিচুড়ি আমার মাও অমনি করে করতেন। তবে এখানে মানুষের ভোগের প্রশ্ন উঠছে কিনা।
তিলকের বৌ ভেঙে পড়া এলোখোঁপা ঠিক করতে করতে বলে, দেবতার ভোগ শেষ পর্যন্ত কাদের পেটে যায় মানুষছাড়া?
তিলক বলে, আহা! থামবে? এই বৃষ্টির মধ্যে দোকানপাট কি তেমন খুলেছে। বল? তুমি বরং সস্তার খিচুড়ি টিচুড়ি কিছু একটা করে দাও।
তিলকের বৌ ফের জ্বলে ওঠে। বলে না, সস্তা নয়। সস্তার খিচুড়ি আমি জানি না। আমি তো সস্তা বাড়ির মেয়ে নই? জানব কী করে?