সত্য কথা। ম্যালাদিন ডাকাতির মালসামান, টেকা-পয়সা গয়নাগাঁটি এই জঙ্গলে বসে ভাগ করেছে তারা। সন্ধ্যের মুখে মুখে বড় ধানচালের আড়তটায় হানা দিয়েছিল। চার পাঁচ বেপারি বসে তখন টাকা গুণছিল। ছুরি উঁচিয়ে সেই সব টাকা নিয়ে তারা এসে ঢুকেছিল এই জঙ্গলে। তারপর চাঁদের আলোয় ভাগ বাটোয়ারা করেছিল। মনে আছে। কতোদূর এল, একথা তাহলে জগুকে জিজ্ঞেস করে কেমন করে!
কিন্তু কিরমানের যে আর চলে না। নাকমুখ দিয়ে ঝা ঝা করে বেরুচ্ছে উষ্ণতা। ল্যাংড়া পাটা টনটন করে। বুকের ভেতরটা হাঁসফাস করে। তেষ্টায় গলাটা হয়ে গেছে চৈত্রের মাঠ। কিরমান আর পারে না। ডাকাতি করতে এসে শেষমেষ বুক ফেটে মরবে নাকি!
তখুনি গলায় আবার সেই হা হা করা তেষ্টা। একটুখানি জিরিয়ে নেবার ফলে কিরমান এখন খানিকটা ধাতস্থ। দুহাতে মাটি ভর দিয়ে ওঠে দাঁড়ায় সে। দেখে জগু বলল, কী অইল গুরু?
পানি খামু।
তারপর হাঁটু অব্দি জলে নেমে দুআজলা ভরে জল খায় কিরমান। অনেকক্ষণ ধরে খেয়ে খেয়ে পেটটা ঢোল করে ফেলে। তারপর নদী থেকে ওঠে আসবে, কিরমানের চোখ যায় মাঝনদীতে। সেখানে জলের তলা থেকে উপরে ঠেলে উঠছে মোলায়েম মাটির চর। দেখে কিরমান বুঝতে পারে নৌকা নেই কোন নদীতে।
বুক কাঁপিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে কিরমানের।
নদী থেকে ওঠে জগুর পাশে বসে কোচর থেকে বিড়ি বের করে সে। নিজে ধরায়, জগুকে ধরিয়ে দেয়। তারপর নদীর দিকে ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে, ঐ জউগ্যা গাঙ্গে চর পড়ল কবেরে?
জগু নড়েচড়ে বলল, দুই সন ধইরা। অহনও চরটা পুরা জাইগ্যা উডে নাই। আহেবার উইট্টা যাইব।
আহারে এই নদীখান কী আছিল আগে! বাইষ্যাকালে ত্যাজ আছিল কী! খরালিকালেও আদাঘন্টা লাগত পার আইতে। আডের দিন কত মহাজনী নাও থাকত গাঙ্গে। আইত, যাইত। মাল্লারা গাইত। ছিপ নাও লইয়া কতবার ডাকাতি করছি আমরা এই গাঙ্গে। আহারে। দিন বদলাইয়া গেছে। তহন আমার শইল্লেও জুয়ানকী আছিল, গাঙ্গেও পানি আছিল। অহন আমিও বুড়া অইচি গাঙ্গেও চর পইরা গেছে।
কোমর থেকে গামছা খুলে বীভৎস মুখটা গলাটা মুছল কিরমান। জগু থলি থেকে দাটা ছুরিটা বের করেছিল। দাটা তার পায়ের কাছে পড়া, ছুরিটা হাতে। আঙুলের ডগায় ধার পরীক্ষা করে সে খচ করে ছুরিটা বসিয়ে দিল নদীর তীরের নরম মাটিতে। ঠিক সেই সময় কোত্থেকে ওঠে সিরসিরে একটা হাওয়া। নদীর জল ছিল স্থির। জলের ভেতর থেকে ঠেলে ওঠা কোমল মাটির চর রোদ পেয়ে ছুরির ধারের মতো চকমক করছিল। সিরসিরে হাওয়ায় জলের স্থিরতা ভেঙ্গে যায়। পেছন থেকে কাশপাতা নত হয়ে লুটোপুটি খায় কিরমান আর জগুর শরীরে।
বিড়ির ধোঁয়া বাতাসে মেশাতে মেশাতে জগু বলল, মোনে অয় দিন ভালাঐ যাইব গুরু।
অত বড় মারটা খেয়ে মরেনি। আর আজ যদি জগুর সঙ্গে মামুলি একটা কাজে এসে মরে তাহলে সাগরেদরা কোনোদিন গুরু বলে তার নাম মুখে আনবে না। ঘৃণা করবে। গালাগালি দিয়ে তার নামের ওপর থুতু ছেটাবে। সে বড় লজ্জা, সে বড় অপমান। কী করা যায়? হাটে আর বুদ্ধি খোঁজে কিরমান। তারপর হঠাৎ থেমে গিয়ে জগুকে ডাকে। ঐ জউগ্যা, হোন।
জগু বেশ অনেকটা এগিয়েছিল। কিরমানের ডাকে পেছনে কিরে তাকায়। কী কও? আডেঐ যাবিনি?
না।
তাইলে!
তাইলে কী?
ল এহেনেঐ বইয়া থাকি। আড তো আর বেশি দূর না।
হ ভালা কথা কইছ। লও বহি।
চিরল পথটা ছেড়ে দুজন মানুষ তারপর নদীর একেবারে কাছে চলে এল। পেছনে কাশবন রোদ আটকে রেখেছে। এমন একটা জায়গায় বসে আকাশের দিকে তাকাল কিরমান। দুপুর প্রায় হয়ে এসেছে। কতোক্ষণ বসে থাকতে হবে আল্লাহ মালুম।
তবুও বসতে পেরে জানটা বেঁচে গেছে কিরমানের। এখন একটু জিরিয়ে ভরপেট পানি খেয়ে নিলে, তারপর বিড়ি ধরালে অপেক্ষা করতে কষ্ট হবে না।
পানি খাওয়ার কথা ভাবতেই শুকনো গলাটা, বৃষ্টির অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে থাকা চষা জমির মতো হা হা করে ওঠল কিরমানের। ইচ্ছে হল নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে যত ইচ্ছে পানি খায়। কিন্তু ল্যাংড়া পা টেনে এত দূর হেঁটে আসার সঙ্গে সঙ্গে পানি খেলে বুকে বাঁধ পড়ে মরবে। জগুর সঙ্গে ডাকাতি করতে এসে মরণ। নামের ওপর থুতু ছিটাবে সাগরেদরা।
কিরমান অপেক্ষা করে। নদীর দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করে। তারপর একটা ব্যাপার খেয়াল করে চমকে ওঠে। রজতরেখা তো দিঘিরপাড়ের হাট ছুঁয়ে পদ্মায় গিয়ে পড়েছে। আগে তো হাটের দিন নদীতে ম্যালা মহাজনী নাও থাকত। মাল নিয়ে হাটে যেত, ফিরে আসত। আজ নৌকা নেই কেন নদীতে!
কিরমান কোনও কথা বলে না। উদাস চোখে নদীর যেখানটায় চর ক্রমশ জেগে উঠছে। সেদিকে তাকিয়ে বিড়ি টানে।
বিড়িতে পুরু দম নিয়ে সুখটান দিয়ে নদীর জলে ছুঁড়ে ফেলে জগু ডাকল, গুরু।
যেন নদীর জলে ডুব মেরেছিল কিরমান। জগুর ডাকে মাথা তুলে বলল, কী কচ?
তুমারে অমুন লাগতাছে ক্যা?
জগুর দিকে মুখটা ফ্যাকাশে করে একটু হাসে কিরমান। কেমুন?
মোনে অয় শইলডা তুমার ভালা না।
কিরমান আবার নদীর দিকে মুখ ফেরায়। বিষণ্ণ গলায় বলে, না শইল ভালাঐ আছে। যা দেহচ হেইডা অইল বয়েস। বয়েস অইলে দুনিয়ার বেবাক জিনিসেরই চেহারা বদলাইয়া যায়। গাঙ্গডারে দেহচ না, কী আছিল আর কী অইয়া গেছে।
হ। তয় তুমারে একখান কতা কই গুরু। তুমি এমুন নামকরা ডাকাইত অইলে কী অইব কতাবার্তা কও বহুত গ্যানি মাইনষের লাহান। হুনলে মোনডা কেমুন করে।