তবু জানে বেঁচে এসেছিল কিরমান। কিন্তু শরীরে যে ভাঙ্গনটা ধরল, তা আর সারল না। শরীরের কতা মনে পড়লেই গেরস্তবাড়ির মেয়েটির কথা মনে পড়ে। মরে গিয়ে জীবনটা অন্যরকম করে দিয়ে গেল কিরমানের।
কালরাতে এসব কথা খুব মনে পড়েছিল কিরমানের বহুকাল বাদে। তারপর আর ঘুম আসেনি কিরমানের। সারারাত জেগে থেকেছে। বিড়ি টেনেছে। তারপর সকালবেলা ওঠে সারা শরীরে চপচপ করে তেল মেখেছে কিরমান। খালি গা, নিম্নাঙ্গে ছেঁড়া লুঙ্গি। কোমরে কিরমান বেঁধেছে লাল গামছা। শক্ত করে। তারপর জগুর সঙ্গে যখন পথে নেমেছে তখন কিরমান বহুকাল বাদে আবার ফিরে গেছে তার যৌবনে। সে একটা দিন ছিল। উন্মাদনার দিন। বিড়ি ধরিয়ে জগু বলল, সড়ক দিয়া যাইবানি গুরু?
কিরমান একটু আনমনা ছিল। চমকে ওঠে বলল, যেহনদা গেলে হবিরে যাওন যায় হেই পথেই ল। আমি বুড়া মানুষ, ল্যাংড়া। বেশি আটতে পারুম না।
তাইলে গাংপাড় দিয়া যাইগা। কাইশবনের ভিতরদা। পথ সোজা অইব। হবিরে যাওন যাইব।
ল।
তারপর দুজন মানুষ সড়ক ছেড়ে নাবালে, কাশবনের ভেতর নেমে যায়। সড়কটা এসেছে মুন্সিগঞ্জ থেকে। তারপর টঙ্গিবাড়ি হয়ে খানিকটা ঘুরপথ চলে গেছে দিঘিরপাড়ের দিকে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সেই সড়কে উঠেছিল দুজন।
কিরমানের মতো জগুরও খালি গা, চপচপ তেলমাখা কিরমানের ছিল ঝাড়া হাত-পা। কিন্তু জর হাতে ছিল ছালার একখানা থলি। তাতে কী আছে কিরমান জানে। ধারালো একখানা হাতখানেক লম্বা দা আর একখানা গুরু জবাই করার ছুরি। থলি হাতে জগুকে দেখে কেউ বুঝবে না কী উদ্দেশ্যে চলেছে মানুষটা।
সড়কে ম্যালা হাটুরে ছিল। জগুকেও দেখাচ্ছিল হাটুরেদের মতো। তার পেছনে কিরমানকে মনে হচ্ছিল ল্যাংড়াখোঁড়া ভিক্ষুকের মতো। যেন দিঘিরপাড়ের হাটে ভিখ মাগতে চলেছে।
কাশবনের ভেতর দিয়ে, রজতরেখার গা ঘেঁষে চিরল একটা পথ সোজা চলে গেছে দিঘিরপাড়ের দিকে। তাড়াতাড়ি হাট ধরতে দুচারজন কারবারি এই পথে চলাচল করে। বিকেলবেলা, কোমরে টাকার তহবিল বেঁধে তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছুবার লোভেও ফেরে কেউ কেউ। সেরকম একজনকে পেলেই কাজ হয়ে যাবে।
সকালবেলার রোদ খুব তেজি ছিল সেদিন। গভীর কাশবনের ভেতরে রোদ পড়ে তা থেকে ছিটকে উঠছিল দমবন্ধ করা একটা গর্মি ভাব। ল্যাংড়া পা টেনে হাঁটতে হাঁটতে কিরমানের তেল চকচকে শরীরে ফুটে উঠছিল শিশির বিন্দুর মতো ঘাম। ক্রমে দরদরিয়ে নামতে থাকে সেই ঘাম। বিকৃত মুখটা গরমে আরো বিকৃত হয়ে গেছে। নাক মুখ দিয়ে বেরুচ্ছিল গরম হাওয়া। হাসফাস করতে করতে তবুও হাঁটে কিরমান। থেমে থেমে। বহুকাল বাদে এতটা পথ হাঁটছে সে। হাঁটাও যে এত কষ্টের কোনোকালে টের পায়নি কিরমান। তবুও হাঁটে। শেষ কষ্টটা তাকে আজ করতে হচ্ছে। তবে নিজের জন্য নয়। জগুর জন্যে। তার অছিলায় যদি জর সংসারের মানুষজন দুবেলা পেট ভরে। খেতে পায় ক বেলা।
জগু হাঁটছিল বেশ দ্রুত। তার কোনো ক্লান্তি নেই। উদ্দীপনা আছে। কাশবনের গরমে সেও খুব ঘেমেছে। ঘামে ভেজা শরীর রোদে চকচক করছে। কিরমানকে ফেলে বারবারই বহুদূর এগিয়ে যাচ্ছিল সে। তারপর কাশবনের আড়াল পড়ে গেলেই কিরমানের জন্যে অপেক্ষা করছিল। কিরমান কাছাকাছি এলে দাঁত কেলিয়ে বলছিল, কী অইল গুরু আটতে পার না?
আগের লাহান কি আর পারিরে। একখান পাও ল্যাংড়া। তিনকুড়ি বয়েস অইল।
তাইলে ইট্টু বহ। জিরাও।
একথায় কিরমানের ভেতর যৌবনকালের চিতাবাঘটা লাফিয়ে ওঠে। জেদে সারা শরীর ছটফটিয়ে ওঠে। হেইদিনকার পোলা জউগ্যা, অর কাছে আমি নত অমু! আমার ল্যাংড়া পাওডার বলও তো রাখে না শইল্লে। বুড়া অইচি কী অইছে। পাওডা ল্যাংড়া না অইলে। আমার লগে আইট্টা পারতনি!
মুখে এসব কথা জগুকে সে বলে না। হা করে শ্বাস টানতে টানতে বলে, না জিরান লাগব না বেডা। কী মোনে করচ তুই আমারে! ল্যাংড়া অইছি কী অইচে, বুড়ী অইচি কী অইছে! মইরা গেছিনি। তর লাহান দুই জুয়ানে অহনেও কাবু করতে পারব না আমারে। জগু বলল, হেইডা জানি গুরু। তয় তুমি অমুন আবজাব করতাছ ক্যা?
গরমে। দেহচ না কেমুন গরম পড়ছে আইজ।
হ। সড়কে কইলাম এত গরম লাগে না। কাইশ্যাবোনে গরমডা বেশি লাগে। হের লেইগাঐ আইজ এই পথে কেঐ নামে নাই। নাইলে এহেনদা তো ম্যালা মাইনষে আডে যায়।
তয়?
তয় কী?
এহেনদা কেঐ না আইলে তর কাম অইবনি?
বিয়ালে আইব। দেইখো নে। হবিরে বাইত যাওনের লেইগা বেবাক কারবারিরা এহেনদা আডেতথন আহে। বিয়ালে কাইশ্যাবোনে এমুন গরম থাকে না।
কিরমান কোনও কথা বলে না। পা টেনে টেনে হাঁটে।
বেলা যত বাড়ছিল রোদ তত তীব্র হচ্ছিল। বাতাসের ছিটেফোঁটাও নেই কোথাও। স্থির কাশবন থেকে রোদের তোড়ে চুটপুটে একধরনের আওয়াজ উঠছিল। আর নিঃশব্দে উঠছিল উষ্ণতা। মানুষের জানপরান আইঢাই করার মতো উষ্ণতা। এসবের ভেতর দিয়ে পা টেনে হাঁটতে হাঁটতে কিরমানের কেবল মনে হয় কত দূর দিঘিরপাড়। কিরমানের বাড়ি থেকে দিঘিরপাড়ের দূরত্ব ছয় মাইল। সেটা সড়কের ঘুরপথে গেলে। কাশবনের এই রাস্তা ধরে গেলে মাইল দেড়েক কমে আসে।
কতদূর এল তারা। জগুকে জিজ্ঞেস করলে জগু খ্যাক খ্যাক করে হাসবে। বেবাক ভুইলা গেছ গুরু। এইডা কুন কতা অইল! কতবার ডাকাতি কইরা এই জঙ্গলে বইয়া ভাগ করছি না আমরা!