মোনের দুখে বাইতথন বাইর অইয়া গেল চোরায়। গিয়া এক জঙ্গলে বইয়া রইল হারাদিন। তারবাদে হাইঞ্জাকালে জিদ কইরা জঙ্গল থন বাইর অইল। তিন কোশ দূরে রাজার বাড়ি। আইজ রাজার বাইতঐ চুরি করতে যাইব। যা আছে বরাতে। চুরি আইজ করব। চুরি না কইরা বাইত ফিরব না। খিদায় জান যায়। রাজবাড়ি যাইতে যাইতে রাইনিশি অইয়া গেল। রাজার বাইত তো, বুজলি জউগ্যা, ম্যালা পাইক পেয়াদা পাহারাদার। চোরায় বহুৎ তদবির কইরা ভিতর বাইত গিয়া হান্দায়। তারবাদে যাইতে যাইতে এক্কেরে রাজকন্যার ঘরে। গিয়া দেহে ঘরের মইদ্যে সোন্দর একখানা ঝাড়াবাত্তি জ্বলতাছে। পালঙ্কে হুইয়া নিদ যাইতাছে রাজকন্যায়। রাজকন্যার গাও ভরা মণি মাণিক্য হিরা জহরতের গয়না। দেইখা চোরের মাথা খারাপ অইয়া যায়। আস্তে আস্তে গিয়া খাড়ায় রাজকন্যার সিতানের সামনে। বেতভারে নিদ যাইতাছে কন্যায়। ইচ্ছা করলেঐ গাও ভরা মণি-মাণিক্য, হিরা, জহরতের গয়না। দেইখা চোরের মাথা খারাপ অইয়া যায়। আস্তে আস্তে গিয়া খাড়ায় রাজকন্যার সিতানের সামনে। বেভোরে নিদ যাইতাছে কন্যায়। ইচ্ছা করলেঐ গাও থিকা বেবাগ গয়না খুইলা লইতে পারে চোরায়। চোরায় পাগলের লাহান আত দিতে যায়। তহনঐ মোনে অয় ওস্তাদের কতা। ওস্তাদে কইছিলো বেগানা মাইয়া মাইনষের শইল্লে আত দিচ না। চোরায় থাইমা যায়। তহন রাজকন্যার এক দাসী আইতে লইছিলো কন্যার ঘরে। চোরারে তো দেইখা হালায়। দেইখা হালানের লগে লগেঐ চিইক্কার মারে। আর যাইবা কই। পাইকপেয়াদারা আইয়া চোরারে ধইরা হালায়। পরদিন বিয়ানে আতবান্দা চোরারে দরবারে লইয়া যায় পাইক পেয়াদারা। চোরার বিচার অইব। ঐ রাইজ্যে চুরির শাস্তি গর্দান। ডরে চোরার কইলজা হুঁকাইয়া যায়। রাজ দরবারে হেয় আর খাড়াইয়া থাকতে পারে না। শইল্লে কাঁপন ধইরা গেছে। আত পাও ঠকঠক কইরা কাপতাছে। সিঙ্গাসনে বইয়া রাজায় জিগাইল, তুই রাজকন্যার ঘরে হানছিলি ক্যা?
চোরায় মোনে করল, গর্দান যহন যাইব তাইলে আর মিত্যা কতা কইয়া ফায়দা কী। হাঁচা কতা কইয়াঐ মরি। কইল, চুরি করতে হুজুর।
তাইলে চুরি না কইরা খাড়াইয়া রইছিলি ক্যা?
হাঁচা কতা কমু হুজুর?
ক।
হুইনা মোনে ইট্টু বল পায় চোরায়। কয়, আমার ওস্তাদে কইয়া দিছিল বেগানা মাইয়া মাইনষের শইল্লে আত দিবি না, মাইয়াছেইলারা মার জাত। আর কিরপিনের ঘরে চুরি করবি না, মাগীর ভাউরার ঘরে চুরি করবি না। আমি বউ পোলাপান লইয়া তিন দিন ধইরা না খাইয়া রইছি। তিনদিনঐ চুরি করতে গেছি। পয়লা রাইতে যার বাইত গেছি, হেয় দেহি মাগীর ভাউরা। চুরি করতে পারি নাই। পরদিন একবাইতে গেছি। গিয়া দেহি হেই বেডা জাত কিরপিন। চুরি করতে পারি নাই। কাইল রাইতে আইছিলাম আপনের বাইত। রাজকন্যার ঘরে গিয়া দেহি হের গাও ভরা মণিমাণিক্যের গয়না। খুলতে গিয়া ওস্তাদের কতা মোনে অইছে। ওস্তাদে কইছিল বেগানা মাইয়ামাইনষের শইল্লে আত দিচ না। হের লাইগা চুরি করতে পারি নাই। ধরা পইরা গেলাম।
বেবাক কতা হুইনা চোরারে রাজায় ছাইরা দিল। লগে ম্যালা ধনরত্ন দিল, জাগাজমিন দিল। বুজছচ জউগ্যা। নিয়মনীতি মাইন্না চল্লে হেই মাইনষে কুনদিন বিপাকে পড়ে না। ভাতে মরে না। তর কুন নিয়মনীতি নাই দেইক্কা এই দশা অইছে।
কিচ্ছা শুনে জগু খুব বিরক্ত হয়েছিল। বলল, এত প্যাচাইল পাইরো না তো। বুইড়া অইয়া গেলে মাইনষে কামের থিকা আকামের কতা বেশি কয়। তুমি কাইল আমার লগে যাইবা। বিয়ানে আইয়া আমি তুমারে লইয়া যামু।
কিরমান আর কোনও কথা বলেনি।
জগু চলে যাওয়ার পরও একাকী অনেকক্ষণ দাওয়ায় বসে থেকেছে কিরমান। বসে বসে বিড়ি টেনেছে। কিরমানের ছাপড়া ঘরের ওপর, ঘরের পেছনকার গাছপালার ওপর ম্যাটম্যাটে জ্যোৎস্না পড়ে ভৌতিক একটা পরিবেশ তৈরি করে রেখেছিল। ঘরের ভেতর জ্বলছিল কুপি। তার ছিটকে আসা আলো এবং ম্যাটম্যাটে জ্যোৎস্নায় দাওয়ায় বসে থাকা কিরমানকে মনে হচ্ছিল প্রাচীন ঝোপঝাড়ের মতো। বিড়ির একবিন্দু আগুনকে মনে। হচ্ছিল জোনাকি পোকার মতো। অনেক রাতে গ্রীষ্মকালের উষ্ণতা কমে গিয়ে পৃথিবী যখন শীতল হতে শুরু করে, গাছপালা আর মাটি থেকে যখন ওঠতে শুরু করে কোমল শীতলতা, তখন কিরমান উঠে গেছে তার ঘরে। তারপর হাঁড়ি থেকে দুপুরে বেঁধে রাখা ভাত সালুন বাসনে নিয়ে যখন খেতে বসেছে, তখন বহুকাল বাদে তার মনে পড়েছে। গেরস্তবাড়ির মেয়েটির কথা। এগার বছর কিরমানের সঙ্গে ঘর করেছিল। পুরনো অভ্যেস বদলে কিরমান যখন দিনে দিনে মানুষ হয়ে উঠেছে তখুনি কলেরায় মরল। মরে কিরমানকে আবার ডাকাত করে দিয়ে গেল। সাগরেদরা ম্যালা চেষ্টা তদবির করেও এগারো বছর কিরমানকে দলে নিতে পারেনি। গেরস্তবাড়ির মেয়েটি মারা যাওয়ার পর আবার তারা এসে ফুসলাতে লাগল। একদিন, দুদিন। কিরমান আবার ডাকাত হয়ে গেল। দিন যাচ্ছিল সুখেই। গেরস্তবাড়ির মেয়েটার শোক ডাকাতের উন্মাদনায় ভুলতে চাইছিল কিরমান। মারটা খেয়ে গেল চরে ডাকাতি করতে গিয়ে। দলের সবাই পালাতে পেরেছিল। ধরা পড়ে গেল কিরমান একা। তারপর হাজার লোকের মার। দুখানা থান ইট হাঁটু আর পায়ের পাতার মাঝখানে রেখে দুদিকে ওঠে দাঁড়াল চউরা দুই তাগড়া জোয়ান। হাড়টা কালিবাউসের শুকনো কাঁটার মতো মট করে ভেঙে গেল। তারপর সেই দুই জোয়ানের একজন গজাল দিয়ে খুঁচিয়ে তুলল কিরমানের একটা চোখ। আরেক জোয়ান খেজুর গাছ চাছার ছেনি দিয়ে আস্তেধীরে চাঁছল কিরমানের দুগালের চামড়া। তারপর রজতরেখার তীরে ফেলে রেখে দিল।