আমিও খেদাইয়া দেই নাই। বুকে তুইল্লা রাখছিলাম। হেয় আমারে পুচ করতো, পোলাপানের লেইগা তুমার মোন কান্দে না?
কইতাম, কান্দে।
তাইলে?
তাইলে কী?
আমার তো বাজা পেট। পোলাপান অইব না।
না অইলে কী করুম। আমার কপালে পোলাপান নাই।
দুখ অয় না?
অয়। তাইলে?
তাইলে কী! তুই বাজা না অইয়া আমি যুদি খোজা অইতাম, তাইলে কী করনের আছিল।
অনেকক্ষণ ধরে এসব প্যাচাল শুনে জগু খুব বিরক্ত হয়েছিল। রুক্ষ্ম গলায় বলল, এই হগল কিচ্ছা হুনতে আমি আহি নাই। কামের কতা কও। তুমি যাইবা? নাইলে সাফ কতা কইয়া দেও। আমি আমিনদ্দির কাছে যাই।
কিরমান কোনও কথা বলে না। আনমনে একবার আকাশের দিকে তাকায়। আকাশের চাঁদ দিনে দিনে আধখানা হয়ে গেছে। কমজোরি একটা জ্যোৎস্না কিরমানের বাড়ির ওপর, গাছপালার ওপর শুকনো কলাপাতার মতো লেপটে আছে। ঘরে মাটির গাছার ওপর বসে টিমটিম করে জ্বলছিল একটি কুপি। একবার ঘরটার দিকেও তাকায় কিরমান। আহা, এই ঘরডায় এগার বচ্ছর আছিল গেরস্তবাড়ির মাইয়াডা। হেয় আইজ নাই। ঘরডা বহুদিন ধইরা আন্দার অইয়া রইছে। কুপি আঙ্গাইলেও আন্দারডা যায় না। বুক কাঁপিয়ে আবার একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে কিরমানের।
জগু বলল, আমিনদ্দির কাছে গেলে কইব গুরুরে থুইয়া আমার কাছে আইছচ ক্যারে? টিটকারি দিব আর হাসব। হেইডা আমার ভাল্লাগব না দেইখাই তো তুমারে এতদিন ধইরা কইতাছি। তুমি তো আইজকাইল আর মাইনষের মইদ্দে নাই। থাকলে ধিকটা তুমার থাকত। জিদটা তুমার থাকত। আমিনদ্দি যহন কইব, হ বেডা থো তগ কিরমাইন্নার কতা। অমুন কত ডাকাইত দেকলাম। বুড়া অইলে বেবাক হালায় মেকুর অইয়া যায়। তহন তুমার ইজ্জতখান থাকব কই! এইডা খালি আমারে কও।
একথা শুনে কিরমানের ভেতর হঠাৎই যৌবনকালের ক্রোধটা একটুখানি ফিরে আসে। বুড়ো বয়সে যখন তখন গলায় খানিকটা শ্লেষ্ম জমে থাকে। খুক খুক করে দুখানা কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে কিরমান। তারপর বলে, তয় তুই আমারে নিবিই জউগ্যা?
আবছা জ্যোত্সায় জগু এবার দাঁত কেলিয়ে হাসে। তুমি কী কও গুরু! না নিলে তুমার কাছে বিলায়ের লাহান এমুন ঘুরঘুর করিনি। তুমি আমারে যাই মোনে কর গুরু আমি কইলাম তুমার ভালাডাই চাই। তুমি বুড়া অইয়া গেছ, কামকাইজ কর না, কী দিয়া কী খাও আল্লায়ই জানে। আমি চাই আমার লগে থাইকা থাইকা দুই চাইরডা পয়সা কামাও তুমি। নাইলে খাইবা কী? দিন যাইব কেমনে?
শুনে কিরমান খ্যাক খ্যাক করে হেসেছে। মাইনষের খাওনদাওন আল্লার আতে। পেড দিছে হেয় খাওনও দিব হেয়। এইডা তর ভাউজে হিগাইছিল আমারে। হ। কতাডা হাচাই। আমি কুনদিন না খাইয়া থাকি নাই। পেডের ভাত আল্লায় জোগাইয়া দিছে।
মাথার বাবড়ি চুল ঝাঁকানি দিয়ে, ভাটার মতো চোখ দুটো পিটপিট করে, মুখের আগাছার মতো দাড়ি গোঁফে অযথা একবার হাত বুলিয়ে জগু বলল, তয় একখান কতা জিগাই তুমারে।
আবছা জ্যোত্সায় জগুর চোখ পিটপিটানিটা দেখতে পায় না কিরমান। বলল, জিগা।
তুমি কুন কামকাইজ করো না। জমিজিরাতও নাই তুমার। থাকনের মইদ্যে আছে এই দশ কদম বাড়িখান আর ঐ একখান ছাপড়া ঘর। তুমি ভাত পাও কই? আর এই যে নিমিষে নিমিষে বিড়ি খাও, এই হগল আহে কইথিকা?
আল্লায় দেয়।
আল্লায় তুমার কাছে ফিরিশতা পাডায়নি?
তুই ছাড়া আমার কাছে যারা আহে তারা ফিরিশতার লাহানই। আমার সাগরেদ আছিল বার তের জন। শেষকালে সেন তুই আইলি। তুই তো একখান খাডাস। আর অরা অইল ফিরিশতা। অহনও ডাকাতি কইরা যা পায় রাইতে আইয়া আমার গুরুদক্ষিণাডা দিয়া যায়। কামকাইজে যাওনের আগে কইয়া যায়, বুদ্ধি লইয়া যায়। একথায় জগুর মনে একটু দুঃখের ভাব হয়। গলা নরম করে সে বলল, আমারে তুমি দোষ দিতে পার না গুরু। তুমি কামকাইজ ছাইরা দেওনের পর আমারে আর কেউ দলে লইতে চায় না। আমার বলে সবাব খারাপ। ডাকাতির সোনাদানা, টেকাপয়সা বলে আতে পাইলে আমি চুরি করি। হামলাইয়া রাখি। যারা এমুন অবিশ্বাস করে তাগো লগে কাম করুম কেমনে! কিরমান রামদার মতো ধারালো গলায় বলল, চুরির অব্যাস তো তর আছেই জউগ্যা। এইডা মিত্যা কতানি! আমার লগে শেষবার তুই যহন বাইনখাড়া ডাকাতি করতে গেছিলি, একখান অনন্ত তুই হামলাইয়া রাকছিলি না! পরে কোকসায় আমার লাত্তি খাইয়া সেন বাইর করলি। মোনে নাই? আ?
জগু এবার খুব দমে যায়। বার দুয়েক ঢোক গিলে খড়নাড়ার মতো শুকনো গলায় বলল, হ, ঐ একবারই তো করছিলাম। কী করুম কও। আমার সংসার বড়। নয়খান পোলাপান। বুড়ো মা আছে, একখান রাড়ি বইন আছে। বইনের আণ্ডাবাচ্চা তিনডা। ডাকাতি কইরা ভাগে যা পাই হেতে ভাত জোডে না।
তর কুনদিন জুটব না। চোরডাকাইতগও নিয়মনীতি থাকন লাগে। বুজছ? তর কুনও নিয়মনীতি নাই। হেইবার আমি লগে না থাকলে দলের মাইনষে তরে কাইট্টা রজতরেখার পাইতে হালায় দিত। কেঐ খবর পাইত না। তর সংসারে খাঐন্না মানুষ বেশি, হেইডা দলের মাইনষেরে কইলে হেরা দয়া কইরা তরে বেশি দিত। আপদে বিপদে তরে সাহাইয্য করত। তুই চুরি করল্লি ক্যা?
জগু মন খারাপ করে বলল, হ, হেই পাপেঐ তো আইজকাইল ভাত জোডে না। নাইলে তো দলেঐ থাকতাম। ছেচড়ামি করন লাগত না। কিরমান বলল, ভাত জোড়ে না দেইক্কাঐ এবার তর লগে আমি যামু। চিন্তা করি না। আমারে দিয়া যুদি তর সংসার কয়দিন ভালা কইরা চলে, হেইডা আমি করুম। তয় হোন, তরে একখান কিচ্ছা কই। এক চোররে হের ওস্তাদে হিগাইছিথল, কুনদিন মাগীর ভাউরার বাইত চুরি করবি না, কিরপিনের ঘরে চুরি করবি না, চুরি করতে গিয়া মাইয়া মাইনষের শইল্লে আত দিবি না, মাইয়ামানুষ অইল মায়ের জাত। হেগ ইজ্জতের উপর জোরজুলুম করবি না। এই তিন কতা যুদি না মানচ, তাইলে দেকবি হাজার সোনাদানা চুরি করলেও জইরা আইব না তর। বউ পোলাপান না খাইয়া মরব। চোরায় ওস্তাদের কতা মাতায় লইয়া পয়লা দিন গেছে চুরি করতে। সিং দিয়া এক গেরস্তের ঘরে হানছে। হাইন্দা দেহে কী, ঘরের মইদ্যে টেমি জ্বলতাছে। দেইখা চোরায় আঐলে খাড়াইছে। খাড়াইয়া দেহে গেরস্তের বউখান বিচনায় হুইয়া রইছে, আর হের মরদে মাতার সামনে বইয়া বউর মাতা আতাইয়া দিতে দিতে কইতাছে, ও বিবিসাব ওডেন। উইট্টা আমারে ভাত দেন। বউডায় কয় কি, নাআ আমিইই উটতেএএ পারুমমম না আআ, আতে পায়ে আইজ সাদ কইরা আলতা দিছি। তুমারে ভাত বাইরা দিলে আমার আতের আলতা বিনাশ অইয়া যাইব। হুইনা মরদে কয় হায় হায় এইডা আমারে আগে কইবেন না। সব্বোনাশ, আপনের আতের আলতা উইট্টা গেলে তো বিষণ খেতি অইয়া যাইব। ভাত আমি নিজেই বাইরা খাইতাছি। আপনে নিদ যান। মোনের আনন্দে নিদ যান। আর রোজ আপনে আতে পায়ে আলতা দিবেন। আমার বুকের উপরে আপনের পাও দুইখান উড়াইয়া নিদ যাইবেন। তাইলে পাওয়ের আলতাও নষ্ট অইব না। এই কতা কইয়া গেরস্তে গিয়া ভাত বাড়তে বহে। দেইখা। চোরার মোনে অইল ওস্তাদের কতা। ওস্তাদে কইছিল, মাগীর ভাউরার বাইত চুরি করবি না। চোরা ফিরত আইল। চুরি করল না। আর এদিকে চোরার ঘরে কইলাম ভাত নাই। বউ পোলাপান না খাইয়া রইচে। নিজে না খইয়া রইচে। খিদায় হারা রাতইত নিদ আহে না চোরার। পোলাপান কান্দে। বউ খিদার চোডে বইক্কা চোরার মরা বাপ জিন্দা করল হারা রাইত। পরদিন চোরায় হারাদিন না খাইয়া থাইকা রাইতে আবার গিয়া এক গেরস্তের ঘরে সিং কাটল। নিশি রাইতে বাড়ির বেবাক মাইনষে নিদ যাইতাছে। তয় একজন খালি জাগনা। বাড়ির মরদড়া। হেয় নিশি রাইতে টেমি জ্বালাইয়া রেজগি পয়সা। গুণতাছে। তিন চাইর টেকার রেজগি গুনতাছে এমুন কায়দা কইরা য্যান কুনো আজ অয়। দুনিয়ার কেঐ য্যান না বোজে। একখান কইরা পয়সা গুণে আর চোরের লাহান। চাইরমিহি চায়। কেঐ আবার দেখলোনি। পয়সার আওয়াজ আবার কেঐ হুনলনি। চোরায় আঐলে খাড়াইয়া খাড়াইয়া বেবাক দেহে। পেডে খিদা। খাড়াইয়া থাকতে থাকতে চোরের ঠ্যাংয়ে বিষ ধইরা যায়। গেরস্তে তিন চাইর টেকার রেজগি গণা আর শেষ অয় না। একখান পয়সা বিশ পঞ্চাশবার কইরা গণে। মোরগে বাগের লগে লগে পয়সাডি একখান ত্যানায় বান্দে গেরস্তে। তারবাদে ছনের ঘরের চালের ভিতরে গুইজ্জা। রাখে। না জানলে দুনিয়ার কেঐ বুঝবো না চালের ছনের মইদ্যে পয়সা হামলাইয়া রাকছে গেরস্তে। টেমি নিবাইয়া গেরস্তে তারবাদে হুইয়া পড়ে। চোরায়তো বেবাকঐ দেখছে। ইচ্ছা করলে চালের ছনের মইদ্যে আত দিয়া পোটলাডা লইয়া লইতে পারে হেয়। তয় চোরায় কইলাম লইল না। ওস্তাদে কইছিল কিরপিনের বাইত চুরি করবি না। পেডে দুই দিনের খিদা লইয়া চোরা ফিরত আইল। বাইত আইয়া দেহে খিদার চোডে বেবাক পোলাপান চিইক্কার পাড়তাছে। খালি আতে চোরায় ফিরছে দেইখা বউ মুইরা পিছা লইয়া বাইরে আইল। পোলাপানের খাওন দিতে পারো না জন্ম দিছ ক্যান। বাইরও বাইত থনে।