ডাকাতি তো করলাম। বাড়ির বেবাক মরদরে চৌচালা ঘরের খামের লগে বাইন্দা, কাডের সিদুক ভাইঙ্গা টেকা-পয়সা লইলাম। মাইয়ামানুষের গতর থিকা খুইল্লা লইলাম সোনার চুরি হার অনন্ত দুল বেবাক। একটা যুবতি মাইয়া আছিল বাইত। গলায় হার, কানে দুল, বাজুতে কঙ্কন। না চাইতে বেবাক খুল্লা দিল। মাইয়াখান এত সোন্দর, দেইক্কা আমার চোক্কে পলক পড়ে না। চাইয়া থাকতে থাকতে দেহি, হের মাজায় মোড়া একখান বিছা। দশ বার ভরির কম সোনা অইব না। দেইক্কা মাইয়াডার চেহারাসুরৎ ভুইল্লা আমি হের মাজায় আত দিতে গেছি, ফাল দিয়া উটল। খবরদার শইল্লে আত। দিবা না। হুইন্না আমি টাসকা লাইগা গেলাম। অই ছেমড়ি কচ কী! আ! শইল খান কি সোনা দিয়া বানদাইছ? আইচ্ছা আত দিমু না। বিছাখান দিয়া দে।
হেয় কয় কী, না দিমু না। কাইটা হালাইলেও দিমু না। এইডা আমার মার মরণের সুময় আমারে দিয়া গেছে। নিতে অইলে আমারে মাইরা হের বাদে নেও।
হুইন্না আমার মাথাডা দুইখান পাক খাইল। কুন কথা না কইয়া হের আত দরলাম। তর বিছা নেওনের কাম নাই আমার। তুইই তাহলে ল আমার লগে। তার বাদে বুজলি জউগ্যা, আত দইরা টাইন্না দুই আড়াই মাইল রাস্তা, হেঁচড়াইয়া লইয়াইলাম এই বাইত। মাইয়া খান কেমুন দেক, এতাহানি রাস্তা আমি টাইন্না হেচড়াইয়া লইয়াইলাম, একবারও আওয়াজ দিল না। ইট্টুও কানল না। ল এক খান বিড়ি খা জউগ্যা, বলে কেঁচড় থেকে আবার বিড়ি বের করছিল কিরমান। নিজে ধরিয়েছিল, জগুকে দিয়েছিল।
জগুর তখন এসব কথা শোনার সময় নেই। চার পাঁচদিন ধরে সে লেগে আছে কিরমানের পেছনে। কিরমানকে নিয়ে হাটের দিন কাজে যাবে। কিন্তু রাজি হচ্ছে না লোকটা। সারাজীবন মানুষের গলা কেটেছে, সিন্দুক ভেঙেছে, আর এই শেষ বয়সে এসে সাধু সেজেছে কিরমান। কথাটা ভেবে চারপাঁচ দিনের মধ্যে এই প্রথম ভেতরে ভেতরে খুব রেগে যাচ্ছিল জগু। আজই শেষ। কাল দিঘিরপাড়ের হাট। শালা রাজি হবে। নয়ত পুব পাড়ার আমিনুদ্দিনকে দলে নেবে জগু। আয়বরকত যে ভালো হবে জানে। হাট সেরে, কোমরে তহবিল বেঁধে বেপারিরা রাত বেরাত বাড়ি ফেরে। একজনকে ধরতে পারলেই কাজ ইনশাল্লাহ হয়ে যাবে।
বিড়ি টানতে টানতে কিরমান আবার একটু উদাস হয়ে গিয়েছিলো। সন্ধ্যার পরপরই চাঁদ উঠেছিল আকাশে। জ্যোৎস্না ছিল। সেই জ্যোৎস্নায় বাড়ির দাওয়ায় বসা দুজন মানুষ। হাতে জোনাকির মতোন জ্বলছিল বিড়ি। জ্যোত্সায় কিরমানের বীভৎস মুখের দিকে তাকিয়ে জগু কী যেন কী কারণে, বুকের ভেতরে নদীর স্রোতের মতো ছটফটানি থাকা সত্ত্বেও ওঠে যেতে পারে না। কথা বলতে পারে না। চুপচাপ থাকে। বিড়ি টানে।
কিরমান বলল, বাইত আইন্না মাইয়াডারে ঘরে উডাইলাম। কুপি আঙ্গাইয়া নিজের মুখের পট্টিখানা খুলোম। খুইল্লা চাইয়া দেহি কী, মাইয়াডা পিটপিট কইরা আমারে দেহে। বুজলাম আমারে হের মোনে ধরছে। ধরব না ক্যা! চেহারাখানা তো আল্লায় দিলে আছিল। রাজা-বাদশার লাহান আছিল। বুজলি জউগ্যা, তরে কইলাম না মাইয়া মাইনষে আমার চেহারা দেখলে মইজ্জা যাইত।
জগু বলল, খালিসেন ভাউজে মজছিল। আর কেউ তো মজে নাই। শুনে কিরমান খ্যাক খ্যাক করে একটু হাসে। হ, তর ভাউজেই মজছিল। ম্যালাদিন বাদে আমারে কইছিল, তুমার চেহারাসুরৎ যুদি খবিসের লাহান অইত তাইলে আমি তুমার লগে থাকতাম না।
হ, ঐ একজনের কাছেই তুমার চেহারা ভালা আছিল, জগুর গলায় শ্লেষের ভাব। ব্যাপারটা টের পেয়ে কিরমান বলল, বেডা তরা তো অহনতরি পোলাপান। মাইয়া মাইনষের মোন তরা কী বুঝবি! একখান মাইয়া মাইনষের মোন দেইখা বেবাক মাইয়া মাইনষের মোনের আসল গুমরডা বুজা যায়। ভালমন্দের জাগায় বেবাক মাইয়া মানুষ এক রকম।
হ, যা কইতাছিলাম। মাইয়াখানরে তো পয়লা দেইখাই আমার মোনে ধরছিল। বাইত আইনা যহন বুজলাম আমারেও হের মোনে ধরছে, তখন সোনাদানা টেকা-পয়সা যা ভাগে পাইছিলাম বেবাক হের পায়ের সামনে হালায় দিলাম। মুলাম গলায় কইলাম, আইজ থিকা আমার বেবাক জিনিস তর। তুই খালি আমার লগে থাকিচ। ছাইরা যাইচ না। যায় নাই রে। কুনদিন যায় নাই। এগার বছর আমার লগে ঘর কইরা মরল। আমার জীবনে সেরা দিন গেছে ঐ এগার বছর। ডাকাতি আমি ছাইরা দিছিলাম। হেয় কইছিল, আমি তুমার লগে থাকুম তুমি যুদি মাইনষের মাথায় বারি দেওন ছাইরা দেও।
চুরি-ডাকাতি ছাইরা দেও।
হুইনা আমি কইলাম, তাইলে তরে আমি খাওয়ামু কী! নিজে খামু কী!
হেয় কইল, তুমার গতর আছে না। গতর খাড়াইয়া কাম করবা। দিন বাদে নাইলে একসন্দা খামু। আমার কুন দুখ থাকব না।
ছাইরা দিলাম। ডাকাতি করন ছাইরা দিলাম আমি। নিজের তো আর খেতখোলা আছিল না। মাইনষের খেতে কামলা দিতাম। আমার কুনো দুখ আছিল না। যেদিন কামলা দিতাম হেদিন ভরপেট খাওন জুটত। না দিতে পারলে, কাম না পাইলে দুইজনে না খাইয়া থাকতাম। তাও দুখ আছিল না। সুখে নিদ যাইতাম।
তয় ভাউজের তর একখান দোষ আছিল। পেটখান আছিল হের বাজা। পোলাপান অয় নাই। এইডা মোনে অয় আগে থিইকাই জানত হেয়। নাইলে আমি টাইন্না লইয়াইলাম এত বড় ঘরের মাইয়া ডাকাতইতের লগে চুপচাপ আইয়া পড়ছিল কেমনে! হেয় জানত বাজা মাইয়ামাইনষের বিয়া কইরা কেঐ ঘরে রাখব না। খেদাইয়া দিব। নিজে থিকা যে হেরে লইয়া যাইতাছে, মানুষ অইলে হেয় তারে কুনদিন খেদাইয়া দিব না।