কেষ্টা বিড়ি টানতে টানতে কয়, তুই খা। আমি নিত্যি খাই।
নেপলা মুলা খায়, আর কথা কয়। তুমি একখান বিয়া কর কেষ্টা দাদা।
শুনে কেষ্টা একটা নিয়াস ছাড়ে। না বাই, বিয়া আমি করুম না।
ক্যা?
আমারে মাইয়া দিব কেডা?
ক্যা, বেলদারগ মাইয়া নাই?
আছিল একখান। কানা বেলদারের মাইয়া। বৈচি। বিয়া অইয়া গেছে এক যুগ, বারো বচ্ছর।
হের লগে বিয়া অওনের কতা আছিল নি তোমার?
হ।
অইল না ক্যা?
কথা কইতে বড় আমুদ পায় নেপলা। মুলা খাইতে খাইতে খুঁটাইয়া খুঁটাইয়া কেষ্টারে বৈচির কথা জিগায়। পাইলায় ভাত ফুটতাছে। আসমান থিকা পৌষ মাইসা শীত নামতাছে। চানখানও ওঠছে আইজ। ফটফইটা চান্নি। খুয়াও পড়ছে। হইলে হইব কী, চান্নিতে দুনিয়া ভাইসা যাইতাছে। খুয়া দেহা যায় না। কেষ্টার খাজুর গাছটায় একখান বাদুড় বহে। আবার উড়াল দেয়। এই সব দেইখা কেষ্টার নিজের জীবনডার কথা মনে অয়। বুকটা আনচান করে।
বৈচির বিয়া অইয়া যাওনের পর থিকা কেষ্টার আর আপন কেওই নাই। ভাই বেরাদর কেওই না। অনেককাল বাদে নেপলারে পাইল আইজ।
বড় আপন লাগে নেপলারে। কত কথা যে কইতে ইচ্ছা করে।
মুলা খাওন শেষ কইরা বিড়ি চায় নেপলা। একখান দেও কেষ্টা দাদা।
নেপলার বিড়ি খাওয়া দেখতে পারে না কেষ্টা। পোলাপান মাইনষে বিড়ি খাইব ক্যা! কিন্তু অহন আর ঐসব মনে হইতাছে না। চাইতেই পেক খুইলা একখান বিড়ি দিল নেপলারে।
বিড়ি পেয়ে নেপলা বড় খুশি। একখান পুরা বিড়ি। নেপলা আমোদে বাঁচে না। চুলার ভিতরে মুখ দিয়া বিড়ি জ্বালায়। টানতে টানতে কয়, কও কেষ্টা দাদা, তোমার বিয়ার কথা কও। কানা বেলদারের মাইয়ার কথা কও।
কেষ্টা আবার একটা নিয়াস ছাড়ে। আর একখান বিড়ি জ্বালায়। তারপর দুঃখী গলায়। কয়, বৈচি আমারে ভাত রাইন্দা খাওয়াইত। কইত আমার লেইগা বড় মায়া লাগে। পালাইয়া পালাইয়া আইত আমার কাছে। আমি কত বকছি বৈচিরে। কত কান্দান কান্দাইছি। হইলে হইব কী, ফাঁক পাইলেই আমার কাছে আইত বৈচি। আমার লেইগা বড় মায়া আছিল মাইয়াডার। কানা বেলদার অর বিয়া ঠিক করল। রাইতে বৈচি পালাইয়া আইল আমার কাছে। কয়, লও আমরা মাতবরের চরে পলাইয়া যাই। গিয়া বিয়াশাদি করি। ঘর বান্দি। আমার সাওস অইল না। কইলাম তর বাপের কাছে আমি যামু। কমু, বৈচিরে আমার লগে বিয়া দিতে অইব। বৈচি কইল, বাজানে তোমার কথা হুনব না। আমি কইলাম, হুনব। গেলাম কানার কাছে। কানা আমারে বাঁশ লইয়া আইল পিডাইতে। বৈচিরে রাখল পাহারায়। তিন দিনের দিন বৈচির বিয়া অইয়া গেল। আমার লগে আর দেহা অইল না। বারো বছর কাইটা গেল। অহন ভিন গায়ে থাকে। পোলাপানের মা অইছে। আমার কথা আর মনে নাই বৈচির।
এই অবদি কইয়া কেষ্টার গলা ভাইঙ্গা আসে। মুখ নিচা কইরা বইসা থাকে কেষ্টা। তার বাদে হাউমাউ কইরা কাইন্দা ওঠে। নেপলারে দুইন্নাইতে আমার কেওই নাই। বাপ আছিল, বাপ গেল। মায় আছিল, মায় গেল। তারবাদে এক বৈচি আছিল বৈচিও গেল। আমি বড় একলারে, এত বড় দুইন্নাইতে আমি বড় একলা।
কিরমান ডাকাতের প্রথম ও দ্বিতীয় জীবন
সড়কে ওঠে জগু বলল, একখান বিড়ি দেও গুরু।
কিরমান তার খোঁড়া পাটা টেনে হাঁটছিলো। বয়েস হল তিন কুড়ির ওপর। গতরে আগের তাকত নেই। কামকাজ ছেড়ে দিয়েছে মেলা দিন। তবুও চারপাঁচ দিন ধরে জগুর ঘ্যানঘ্যানানি, খোঁচাখুচি তাকে আজ বাড়ি থেকে বের করেছে।
কাল সন্ধ্যায় জগু এসে বলল, কাইলই তো আডের দিন। যুদি যাইতে চাও তাহলে আমারে কইয়া দেও। তুমি গেলে যাইবা নইলে সাফ কথা কইয়া দিবা। আমি পুব পাড়ার আমিনদ্দিরে লইয়া যামু।
শুনে কিরমান উদাস গলায় বলেছিল, হ, হেইডাই কর জউগ্যা। আমার ম্যালা বয়স অইছে। তগ লাহান জুয়ানকি নাই শইল্লে। কাম কাইজ ছাইড়া দিছি। আমারে লইয়া গেলে তর সুবিদা অইব না।
জগু বলল, সুবিদা অসুবিদার কিছু নাই। তুমার কোনও কাম করন লাগব না। তুমি খালি আমার লগে লগে থাকবা। তুমার যা একখান চেহারা, হেইডা দেকলে মানুষে বাবাগো কইরা চিইক্কাইর দিব। তুমার চাওনও লাগব না, লগে যা আছে বাজান কইয়া দিয়া দিব। লুঙ্গির কোচড় থেকে বিড়ি বের করেছিল কিরমান। তারপর ধরিয়ে প্রথম টানের সঙ্গে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল। চেহারাখান কি আর এই রকম বদখত আছিল রে! তুই তো পোলাপান মানুষ! বয়েসকালের চেহারাখান দেহচ নাই আমার। রাজা বাদশার লাহান চেহারা আছিল। শইলের রংখান আছিল কালাই। তয় চেহারাখান আছিল! মাইয়া মাইনষে একপলক দেইক্কাই মইজ্জা যাইত। তর ভাউজরে আনছিলাম ডাকাতি কইরা। নশংকরের মাইয়া। আমার দলে তখন সতরজন মানুষ। তর ভাউজ আছিল বহুৎ বড় গেরস্ত ঘরের মাইয়া। বচ্ছরেরডা খাইয়া থুইয়া হাজার দুই হাজার মোণ ধান বেচত। পাট কাউন বেচত হের বাপচাচারা। দিঘিরপাড়ের আডে একবার আষ্টশ মোন ধান বেচছে হেরা। আমার কাছে খবর আইল বিয়ালে। বাইট্টা জহা আছিল আমার খবরদার। জহারে তুই দেহচ নাই। কলেরা অইয়া মরছে হালায়। তয় জহার কাছে খবর পাইয়াই বেবাকতেরে ডাইকা আনাইলাম। নগদ টেকা আছে নশংকরের গেরস্তবাড়ি। ল যাই। গেলাম। বুজলী। সতরজনে মিল্লা গেলাম। পরনে লুঙ্গি। খালি শইল্লে চপচপা কইরা কইরা তেল মাখাইলাম। জাইপটা যুদি কেউ ধইরা হালায় পিচলাইয়া যাওন যাইব। লুঙ্গির উপরে মাজায় লাল একখান কইরা গামছা গিট্ট দিয়া বান্দা। মুখে বান্দা কালো একখান কইরা কাঁপোড়। হাজার চাইয়া দেখলেও চিনোন যাইব না।