ঘোড়ার পাছায় ছিটকি মাইরা বাজারের দিকে যায় কেষ্টা। একখান আণ্ডাও কিন্না লইব। ভাতের লগে সিদ্ধ করলে খাইতে আরাম হইব।
বাজারের মুখেই করিমের ডাক্তারখানা। ভদ্রলোকের বাড়ির বাংলাঘরের লাহান ডাক্তারখানাডা। চৌচালা পাটাতন ঘর। ঢেউ টিনের বেড়া দেওয়া। ডাক্তারখানা বন্ধ কইরা করিম বিয়ালে বাড়িত চইলা গেছে। বাড়ি হইল দোগাছি। বিয়ানে আইসা আবার দোকান খুলবে। চুরিডাকাতির ডর নাই। চকিদার হারা রাইত পাহারা দেয় বাজার। আর চুরিডাকাতি আইজকাল হয়ও না। কাউল্লা চোরা মইরা যাওনের পর থিকা দেশগেরাম ঠাণ্ডা। চোরডাকাইত নাই।
তয় চোর আছিল একখান কাউল্লা। পুলিশের লগে দুস্তি আছিল তার। হেগ কাছ থনে বিড়ি চাইয়া খাইত। পিডে রুলের পয়লা বাড়ি পড়লে বিসমিল্লা কইত।
হেই কাউল্লারে মারল দশ গেরামের পোলাপানে। তখন জয় বাংলার দিন। চক্ষু বাইন্দা কালীর খিলের মাঠ দিয়া কাউল্লারে আড়াইয়া নিল দুলাল মিয়ার দল। দুইফর বেলা। লইয়া গেল গাংপার। তারবাদে ছুরি দিয়া পাড়াইয়া পাড়াইয়া মারল। চক্ষু দুইখান উড়াইয়া চিলেরে খাওয়াইল। তারবাদে লাশখান দিল পদ্মার পানিতে ভাসাইয়া। দেশগেরাম ঠাণ্ডা। অহন আর চুরিডাকাতি নাই। দুয়ার খুইলা সুখে নিদ্রা যায় দেশ গেরামের মাইনষে।
কাউল্লা চোরার কথা চিন্তা করতে করতে বাজারের মইধ্যে দিয়া ঘোড়া খানরে হাঁটায় কেষ্টা। সাঝ রাইতেই নিটাল হইয়া গেছে বাজারটা। পৌষ মাইসা শীত। মাইনষে খাইয়ালইয়া কাথার নিচে ঢুইকা গেছে। দোকানিরা দোকানপাট বন্ধ কইরা হুইয়া পড়ছে। খালি মাছ বাজারের চালাখানের পুব ধারে রমেশের মনোহারি দোকানটা খোলা। মাথার ওপর হারিকেন লটকাইয়া ছিটকি ঝোপের লাহান বইসা রইছে রমেশ। গায়ে পুরান একখান চাইদ্দর। বইসা বইসা বিড়ি টানতাছে। আর দোকানের সামনে মাটিতে জুবুথুবু হইয়া বইসা রইছে মুচিপাড়ার নেপলা।
জয় বাংলার কালে মেলিটারিরা মুচিপাড়ায় আগুন দিছিল। নেপলার গুষ্টি-গেয়াতি খতম। পাঁচ ছয় বছরের নেপলা বাইচ্চা গেল। অহনে বাজারে থাকে। ভিক মাইগা খায়। দোকানিগো ফুটফরমাইশ খাটে। ভাও বুইজ্জা চুরি চামারি করে। দিন চইল্লা যায়।
ঘোড়াখানরে মাছচালার মইধ্যে খাড়া করাইয়া লাফাইয়া নামে কেষ্টা। শীতে হি হি করতে করতে রমেশের দোকানের সামনে গিয়া খাড়ায়। এক পেক বিড়ি দেও দাদা, এককান মেচ আর একখান আসের আণ্ডা। রমেশ বুইড়া হইয়া গেছে। চিনতে পারে না, কেডা? গলা লম্বা কইরা জিগায়, কেডারে?
নেপলা কয়, কেষ্টা দাদায়।
রমেশ বলল, এত রাইতে কই থিকা আইলি কেষ্টা?
কেষ্টা হি হি করতে করতে কয়, দিগলি গেছিলাম। ভেণ্ডারের ধান টানছি।
রমেশ হারিকেনের আলোয় আস্তে আস্তে সদাই দেয়। খুঁটাইয়া খুঁটাইয়া পয়সার হিসাব করে।
কেষ্টা জিগায়, বেচাকিনা কেমুন দাদা?
রমেশ কথা কওনের আগেই আগ বাড়াইয়া কথা কয় নেপলা, ভালোই।
শুনে শিয়ালের লাহান খেকায় রমেশ, তুই কতা কইছ না মুচির পো। যা অহনে।
কই যামু। আমার গুম আইতাছে।
যেহেনে ইচ্ছা যা। আমার ঘরে থাকতে পারবি না।
তয় থাকুম কই?
হেইডা আমি জানি? আমি তর কেরে?
গামছায় সদাই বানতে বানতে কেষ্টা কয়, কিরে নেপলা থাকনের জাগা নাই?
না দাদা।
ল আমার লগে।
লন।
নেপলা ভাউয়া ব্যাঙের লাহান একখান লাফ দেয়। আপনের ঘোড়াখান কো?
আছে। ল।
ঘোড়াখান খাড়াইয়া আছিল আন্ধারে। সামনে গিয়ে নেপলারে পয়লা ঘোড়ার পিঠে বসায় কেষ্টা। তার বাদে নিজে ওঠে। আন্ধার ভাইংগা হাঁটে ঘোড়াখান। পুব আসমানে ক্ষয়া চান্দখান উইঠা আসে তখনই।
.
বাড়িত আইয়া ঘোড়াখানরে ছাইড়া দেয় কেষ্টা। যা, খাইয়া আয়। ঘোড়াখান কেষ্টার সব কথা বোঝে। ছাইড়া দিতেই বিলের দিকে চইলা যায়। চিহি শব্দে আল্লাদের একখান ডাক দেয়। শুইনা নেপলা বড় খুশি। কেষ্টারে কয়, তোমার ঘোড়াডা বড় ভালা দাদা।
কেষ্টা ঘরের ঝাঁপ খোলে। কয়, হরে বড় ভালা ঘোড়াখান। আমারে বাচাইয়া রাখছে। ঘোড়াডা না থাকলে কবে না খাইয়া মইরা যাইতাম আমি।
নেপলা আর কোনও কথা কয় না। লম্বা কোটের জেবে দুই হাত ভইরা বাড়ির মইদ্দে চক্কর খায়।
কেষ্টা এখন ঘরের ভেতর। চাউল বাইর করতাছে। রানতে বইব। উঠানের কোণায় একখান চুলা। কয় থাবা নাড়া পইড়া রইছে। কেষ্টা মাইট্টা পাইল্লায় চাউল লইয়া বাইর অয়। মেচখান দেয় নেপলারে। চুলায় আগুন দে নেপলা। ভাত রান্দি, খাইছনে।
শুনে নেপলা বেজায় খুশি। চুলার ভেতরে নাড়া ভইরা ম্যাচ জ্বালায়। কেষ্টা যায় খালের দিকে। চাইল ধুইবে।
ওস পইড়া নাড়াগুলি বেবাক ওদাইয়া রইছে। ফুঁ দিয়া আগুন জ্বালায় নেপলা। তার বাদে চুলার ওপরে নিজের হাত দুইখান ছেকে। বেজায় আরাম লাগতাছে। রাইতখান বড় ভালা কাটব আইজ। খালপাড় থিকা উইঠা আসতে আসতে কেষ্টা যায় ওফাজউদ্দির মুলা ক্ষেতে। দুই তিনখান মুলা উঠাইব। গরম গরম ভাতের লগে কচচাইন্না মুলা, বড় স্বাদের। রসে মুখ ভইরা যায়।
মুলা ক্ষেতের কাছে শিয়ালের আওয়াজ পাওয়া যায়। শিয়ালের আওয়াজ পাইয়া কেষ্টা দুবার হুরো দেয়। তার বাদে নিজের কামে যায়।
ফিরা দেখে চুলায় আগুন জ্বালাইছে নেপলা। দেইখা কেষ্টা বড় খুশি। কামের আছে ছেমড়াডা। মাইট্টা হাড়িখান চুলায় দেয় কেষ্টা। তার বাদে নাড়ার ওপরে বইসা নতুন প্যাক খুইলা একখান বিড়ি ধরায়। নেপলা তখন কাঁচা মুলা খাইতাছে। কচকচাইয়া মুলা খায় আর হাসে। বড় স্বাদের মুলা কেষ্টা দাদা। খাইয়া দেহ।