খোকা বসেছিল আসনপিড়ি করে। চোখ দুটো মরামাছের চোখের মতো তার। মাথায় পুরোনো দরদালানের আনাচে-কানাচে যেমন ঝুলে থাকে মাকড়সার জাল তেমন না সাদা না কালো লম্বা ঝকরমাকর চুল। লম্বাটে মুখে, ঠোঁটের ওপর গুটিকয়, থুতনিতে গুটিকয় দাড়ি গোফ। মহল্লায় খোকার আরেক নাম মাকুন্দা খোকা। খোকার পরনে ছিল হাফহাতা নীল পলিয়েস্টারের একটা শার্ট, নীল প্যান্ট। কতকাল ধোয়া হয়নি কে জানে, আসলে রঙটা মুছে গেছে। গাঁজা ভর্তি সিগ্রেট ধরিয়ে খোকা বলল, হ, রতনার মার টাইমলি বিয়া অইলে রতনার বাপের সমান পোলা থাকত। এ কথায় মজনু আবার হাসে।
বাচ্চু বলল রতনার মায় হালায় কেমুন মানুষ! এত বড় একখান পোলা থাকতে কেডা আবার বিয়া বয়।
সিগ্রেট খুব লম্বা একটা টান দিয়ে পুরো ধোঁয়াটা বুকে আটকে রেখে সিগ্রেটটা বাছুর হাতে দেয় খোকা। তারপর কোঁৎ করে একটা ঢোক গিলে ধোয়াটা পুরো হজম করে বলে, এর লেইগাই রতনা হালায় বরবাদ অইয়া গেল।
খোকার কায়দায় বাচ্চুও লম্বা টান দিয়ে সিগ্রেটটা দিল মজনুর হাতে। তারপর বলল, রতন একলা বরবাদ হহছেনি? আমরা হই নাই?
কথাবলার ফাঁকে ফাঁকে বাচ্চুর নাক মুখ দিয়ে গল গল করে ধোয়া বেরোয়। ফলে চারপাশের হাওয়া গাঁজার গন্ধে ভরপুর হয়ে ওঠে। খোকার মতো ধোয়া হজম করাটা এখনও রপ্ত করতে পারেনি বাচ্চু।
মজনুর হাতেই শেষ হয়ে আসছিল সিগ্রেটটা। প্রথমটা শেষ হয় এইভাবেই। সবাই এত বেশি তৃষ্ণার্ত থাকে, একেকটা টান হয় তিন চারটে টানের সমান। পরেরগুলো আবার এত দ্রুত শেষ হবে না। তবুও তিনটে সিগ্রেট আধ ঘণ্টা খানেক কেটে যাবে। তারপর আবার বানানো হবে তিনটে। মোট সিগ্রেট এক প্যাকেট। মোট পুরিয়া তিনটে। এতেই চালাতে হবে আজকের দিন। এটুকুর জন্যে চার পাঁচ টাকা যোগাড় করেই জান বেরিয়ে গেছে ওদের। সারাটা সকাল ঘুরে বেড়াতে হয়েছে তিনজনকে। নয় তো রতনাকে দেখতে সকালবেলাই হাসপাতালে আসতে পারত ওরা। খবরটা তো পেয়েছিল সকালবেলাই। রতনাদের মহল্লার পাশ দিয়ে গেছে ময়লা নোংরা একটা খাল। সেই খালপাড়ে আছে পুরোনো কালের ভাঙাচোরা এক মন্দির। সেই মন্দিরের চত্বরে এসে সকালবেলা বসে এই চার যুবক। তারপর দিনমান আড্ডা মারে, গাঁজা খায়। এক টাকা দুটাকা করে প্রতিদিনই যোগাড় করে আনে ওরা। গাঁজা কেনে, সিগ্রেট কেনে। দিন চলে যায়। আজ সকালবেলা একে একে ওরা তিনজন এসেছে। রতনা আসেনি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে ওরা গেছে রতনাদের বাড়ি। গিয়ে শুনেছে। রতনাকে কালরাতে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রতনা তিরিশ-চল্লিশটা স্লিপিং ট্যাবলেট খেয়েছে। শুনেই মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল ওদের। তখুনি হাসপাতালের দিকে রওনা দিয়েছে ওরা। উদভ্রান্তের মতো। কিন্তু একটিও পয়সা ছিল না কারো কাছে। একদিকে রতনার জন্যে দুশ্চিন্তা, রতনা এতক্ষণ বেঁচে আছে কি মরে গেছে, অন্যদিকে সময় হয়ে গেছে বলে গাঁজায় নেশা চাগা দিয়েছে মাথায়, পয়সার ধান্দায় সকালটা কখন দুপুর হয়ে গেছে, কেউ টের পায়নি। তারপর চার পাঁচ টাকা যোগাড় করে জিনিসপত্র নিয়ে ওরা এসে বসেছে এখানটায়। খবর পেয়েছে রতনাকে ওয়াস দেয়া হয়েছে। কিন্তু রতনার এখন জ্ঞান ফেরেনি। বিকেল নাগাদ ফিরবে হয়তো। তখন ভিজিটিং আওয়ার থাকবে। রতনাকে দেখবার জন্য ওরা হাসপাতালে ঢুকতে পারবে।
প্যান্টের ভেতর থেকে তখন হাত বের করেনি মজনু। মানে চুলকে যাচ্ছে। তার ওপর গাঁজার নেশাটা একটু একটু ক্রিয়া করতে শুরু করেছে। চোখে লালচে একটা ভাব এসে গেছে। এই সময় তলপেটের নিচের অংশটা চুলকে ভারি একটা আরাম বোধ হচ্ছিল তার।
বাচ্চু বলল, আবে মউজনা কতুক্ষুণ ধইরা খউজাচ?
শুনে খোকা খ্যাক করে হাসে। একটানেই ধরছে হালারে। অহন কোনও কাম শুরু করলে সহজে আর থামবে না।
মজনু বলল, আবে না। খাউজানি অইছে। কুচকিমুচকি ছিল্লা গেছে।
খোকা বলল, খাউজানি তো আমাগো বেবাকতেরই আছে। দিনরাইত একখান প্যান্ট পিন্দা থাকি। মাসে-দুই মাসে কাপড় ধুই না। খাউজানি অইব না কী অইব।
বাচ্চু বলল, হ। আর ভাল্লাগে না।
তারপর একটু থেমে বলল, ওই খোকা আমাগো জীবনডা কি এমনেই যাইবনি?
খোকা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, তাইলে কেমন যাইব? আমরা অইলাম বাতিল মাল। এক টাইমে কলেজে পড়ছি, ভুইলা গেছি। স্বাধীনের পর রংবাজি করছি। মাল কামাইছি, তখন বাড়িঘরেও আমাগো দাম আছিল। তহন আমরা অইয়া গেছি কুত্তাবিলাই। মা-বাপে বাড়িতথন দূর দূর কইরা খেদাইয়া দেয়। ভাত খাইতে বইলে গাইল দেয়। আটআনা এক টেকা চাইয়া পাই না। পাঁচ বচ্ছরে একখানা নতুন শার্ট প্যান্টের মুখ দেহি না। শইল্লে খাউজানি। ডাক্তারের কাছে যাইতে পারি না। এর থিকা মইরা যাওন ভালা। রতনা হালায় ঠিকই এটেম নিছিল।
মজনু বলল, কিন্তু মরতে পারল না হালায়। ওয়াস দিছে। অহন জ্ঞান আইলেই ভালা অইয়া যাইব। বাচ্চু বলল, রতনা হালায় টেকা পাইল কইরে খোকা?
কিয়ের টেকা?
ট্যাবলেটটা কিনোনের।
কী জানি।
মজনু বলল, আবে মরণের ইচ্ছা অইলে টেকার যোগাড় অয়। খোকা আবার একটা সিগ্রেট ধরাল।
বাচ্চু বলল, এই খোকা ল আমরা আবার রংবাজি স্টার্ট করি। অহন আবার রংবাজ অইলে টেকা-পয়সার আকাল থাকব না। তিরিশ বছরের লাহান বয়েস অইল, এইডাই শেষ চান্স। ল অহন কিছু টেকা-পয়সা কামাইয়া বইয়া যাই। নইলে হারাজীবন এমনেই চলতে অইব। কোনদিন দেখবি আমরা বেবাকতেই রতনার লাহান এটেম লইতাছি।