সন্ধেবেলা একদিন পেল্লায় চাঁদ ওঠল আকাশে। সোনাদাস ছিল নদীর পারে। আকাশে চাঁদ দেখে গদিতে ফিরল। আজ বুঝি পূর্ণিমা। জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে দুনিয়া। দেশে এই বুড়ো বয়সেও সোনাদাসের বেশ একটা আমোদ লাগে। খুশিমনে, বিড়ি টানতে টানতে গদিতে ফেরে সোনাদাস। ফিরেই একটা নতুন কথা শোনে।
গগনবাবু বিষণ্ণ ভঙ্গিতে বসেছিলেন গদিতে। ধুতি আর কোরা গেঞ্জি পরা। সামনে হারিকেনটা টিম টিম করে জ্বলছে।
সোনাদাসকে দেখেই ডাকলেন বাবু। আয় সোনা কথা আছে।
সোনাদাস অবাক হয়ে গদির কাছে এক কোণে জড়সড় হয়ে বসে।
বাবু একটু গলা খাকারি দিলেন। তারপর বললেন,আমি কাইলই যাইতাছিগা সোনা। সোনাদাস অবাক হয়ে বলল, কই?
জানছ না?
না, আমি তো কিছু জানি না।
কইলকাত্তা যাইতাছিগা।
শুনে আকাশ থেকে পড়ল সোনাদাস। বোকার মতো বলল, আপনের আড়ত? গদি? গদি বেইচা ফালাইছি।
তারপর সোনাদাসের মুখে খানিকক্ষণ কোনও কথা নেই। এক পলক আড়তের দিকে তাকাল সোনাদাস। তাকিয়ে দেখতে পেল গদিরঘরটা অমাবশ্যা রাতের মতো অন্ধকার হয়ে গেছে। কিন্তু আজ পূর্ণিমা, বাইরে মন ভালো করা অদ্ভুত জ্যোৎস্না। সোনাদাস সব ভুলে গেল।
গগনবাবু বললেন, তগো লেইগা বড় মায়া অয়! এহেনে হারাজীবন কাটাইলাম, যাইতে কি মন চায়। কী করুম? বুড়া অইয়া গেছি। কুনসুম মইরা যামু। এহেনে মরলে মুখে আগুন দেওনের মানুষ নাই। পোলাপানের কাছে গিয়াই মরি।
তারপর আর কোনও কথা বলে না গগনবাবু, সোনাদাসও না। টিমটিমে হারিকেনটা মাঝমধ্যিখানে বসে জ্বলে যায়।
খানিকপর ওঠে সোনাদাস। গগনবাবু বললেন, কই যাছ?
সোনাদাস কীরকম এক দুঃখী গলায় বলল, আইতাছি।
বাইরে এসে সোনাদাস টের পায় বুকের ভেতরটা কেমন করছে। এই বুড়ো বয়সে। কাঁদবে নাকি সোনাদাস! চিৎকার করে কপাল চাপড়ে কাঁদবে খানিকক্ষণ!
কাঁদলে লোকে হাসবে।
একটা বিড়ি ধরিয়ে বাজারের পেছন দিকটায় যায় সোনাদাস।
বাজারের পেছনে বিশাল মাঠ। মাঠের পর ধানী বিল মাইল মাইল জায়গা নিয়ে পড়ে আছে। বহুদূরে গ্রামপ্রান্তর। গ্রামের মাথায় ফুটে আছে চাঁদ। জ্যোৎস্নায় ঝিমঝিম করছে চারদিক।
সোনাদাস ক্লান্ত বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাঠ ভেঙে হেঁটে যায়। কোথায় যায়, কে জানে! এত বড় পৃথিবীতে সোনাদাসের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।
হাসপাতালের সামনে
মজনু বলল, রতনারে হাসপাতালে আনল কে রে?
ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে ঢোকার মুখে গাড়িবারান্দার মতো একটা জায়গা। মাথার ওপর ছাদটা উত্তর দক্ষিণে খোলা। এ্যাম্বুলেন্সগুলো এসে জায়গাটায় মুহূর্তের জন্যে দাঁড়ায়। রোগী থাকলে নামিয়ে দিয়ে যায়।
বারান্দাটার পশ্চিম দিকে পাঁচ ধাপ সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি ভেঙে হাসপাতালে ঢুকতে হয়। সিঁড়ির ঠিক উল্টোদিকে মাঝখানে দুটো গাড়ি পাশাপাশি দাঁড়াতে পারে এমন জায়গার পর উঁচু একটা বেদি। ওরা তিনজন বসেছিল বেদিটার ওপর। এখন ঝাঁ ঝাঁ দুপুর। হাসপাতালে ঢোকার মুখে টুল নিয়ে বসে। লোকজন বলতে গেলে নেই এই সুযোগে দারোয়ান লোকটা টুলে বসে ঢুলছে।
মজনু আড়চোখে দারোয়ানটার দিকে একবার তাকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল, ওই খোকা, রতনারে হাসপাতালে আনল কে?
খোকা ততক্ষণে হাতের কাজ প্রায় গুছিয়ে এনেছে। এতক্ষণ ধরে, তিনটে স্টার সিগ্রেট থেকে সুকা বের করেছে বাচ্চু। সাদা খালি তিনটা সিগ্রেটের খোসা পড়ে আছে ওদের মাঝখানে। সুকাগুলো স্তূপ করা খোসার পাশে। সুকার স্তূপ থেকে খানিকটা হাতের তালুতে নিয়ে, পকেট থেকে গাঁজার একটা পুরিয়া বের করে দুটো জিনিসের চমৎকার মিশেল দেয়ার কাজটা সেরে ফেলেছে খোকা। এখন সে আর বাচ্চু মিলে সিগ্রেটের খালি খোসায় ভরার কাজ বেশ যত্নে করে যাচ্ছে। এই কাজে মজনুর হাত খুব সূক্ষ্ম নয় বলে খোকা এবং বাচ্চু ওকে কখনও হাত লাগাতে দেয় না। রতনা তো গাঁজা বানানোর সময়। মজনুকে দেখলেই রেগে যেত। বাঞ্চোত গালটা রতনার খুব প্রিয়। গাঁজা বানানোর সময়। প্রায়ই গাঁজাটা সে মজনুকে দিত। আজ রতনা নেই সুতরাং গালটা মজনুর একবারও খেতে হয়নি।
বেদিতে বসে পা দোলাতে দোলাতে মজনু খোকা আর বাচ্চুকে গাঁজা বানাতে দেখে পর পর দুবার রতনার ব্যাপারে একই প্রশ্ন করল।
গাঁজা ভর্তি সিগ্রেটগুলোর মুখ তখন ম্যাচের কাঠি দিয়ে ঠেসে দিচ্ছিল খোকা। মজনুর কথার সে কোনও জবাব দেয় না দেখে বাচ্চু বলল, রতনার বাপেই আনছে।
কচ কী?
হ।
বাপের লগে না রতনার দুশমনি।
খোকা তখন দুহাতের তালু একত্র করে চটাপট শব্দে হাত থেকে গাঁজা এবং সিগ্রেটের সুকার লেগে থাকা টুকরাটাকরা পরিষ্কার করে খেঁকিয়ে ওঠে, বাপের লগে দুশমনি থাকব না তো দুসতি থাকবনি বে? ওই হালায় কি রতনার আপন বাপ? আছিল তো রাজাকার। স্বাধীনের পর আমাগ হাতে-পায়ে ধইরা জান বাঁচাইছে। মহল্লার মানুষ দেইখা আমরা হালারে ছাইরা দিছিলাম। রতনা ছাড়তে চায় নাই। রতনার আসল বাপরে তো পাকিস্তানীরা মাইরা হালাইছিল। পরে দেহি এই হালা রাজাকারের বাচ্চার লগে রতনার মার পিরীত। বাচ্চু বলল, ওই খোকা, রতনার মায় রতনার বাপের থিকা বড় হইব না?
শুনে মজনু খিক খিক করে হেসে ওঠে। তারপর খাকি রঙের ধুলোমলিন প্যান্টের ভেতর। হাত ঢুকিয়ে তলপেটের নিচটা ঘচর ঘচর করে চুলকাতে থাকে। চুলকানির যন্ত্রণা ও সুখ মিলেমিশে মজনুর ভাঙাচোরা রুক্ষ্ম, দাড়িগোঁফে একাকার মুখটা বিকৃত করে তোলে।