আলতাদের বাড়ি ওঠে আবার একটা বিড়ি ধরাল সোনাদাস। নগদ দশ টাকা কামাই, খেলা কথা না। সেই সুখে সোনাদাস আজ রাতভর বিড়ি টানবে। ঘুমটা তো মাটি হবেই, বিড়ি খাওয়া ছাড়া আর কী করার আছে!
উঠোনে দাঁড়িয়ে বিড়ি টানতে লাগল সোনাদাস। ঘরের ভেতর থেকে কোনও শব্দ আসে কিনা শোনার চেষ্টা করল। মাঝেমধ্যে বুড়ি মাকে অন্য বাড়িতে থাকতে পাঠায় আলতা। খদ্দের নিয়ে ঘরে শোয়। যেসব খদ্দেরের মেয়েমানুষ নিয়ে শোয়ার জায়গা নেই তাদের জন্যে এই ব্যবস্থা। ওরকম হলে পয়সা বেশি নেয় আলতা।
না, আজ ঘরে তেমন কেউ নেই আলতার। থাকলে কথাবার্তার আওয়াজ পাওয়া যেত। মেয়েমানুষের সঙ্গে শুয়ে সাঁঝরাতেই ঘুমিয়ে পড়ে না কেউ।
তবু খানিকক্ষণ কান পেতে রাখে সোনাদাস। ছাপড়া ঘরের পেছনে কলাপাতায় বৃষ্টি পড়ার শব্দ হচ্ছে। অবিরাম ডাকছে ঝিঁঝি পোকা। নাবালের দিকে ব্যাঙের ডাকও শোনা যায়।
নিশ্চিত হয়ে গলা খাকারি দিল সোনাদাস। আলতা জেগেই ছিল, সোনাদাস ডাকার আগেই ঘরের ভেতর থেকে আওয়াজ দিল, কেডা?
আমি, সোনাদাস। ঘুমাইছচনি আলতা?
না, কির লেইগা?
ওঠ। বাজারে যাইতে অইব।
কার ঘরে?
গগনবাবুর আড়তে। নতুন বেপারি আইছে। ভালা টেকা দিব তরে।
টাকার আওয়াজটা সোনাদাস দিল বানিয়ে। লোভ না দেখালে আলতা যদি বৃষ্টিবাদলের রাতে ঘর থেকে না বেরুতে চায়! তা হলে দশটা টাকা।
কিন্তু সোনাদাসকে খুশি করে ওঠল আলতা। নিচু স্বরে বুড়ি মার সঙ্গে গোটা দুই কথা বলল, তারপর বেরিয়ে এল। সোনাদাস টের পেল ঠিক সেই মুহূর্তে বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা দশ টাকা কামাই করার সুখে কুনোব্যাঙের মতো লাফাচ্ছে। বাইরে এসে আলতা বলল, বেপারি আইছে কইথন?
সোনাদাস খুশিমনে বিড়ি টানতে টানতে আলতার সঙ্গে হাঁটে।
অন্ধকারে কেউ কারো মুখ দেখতে পায় না, তবু দুটো মানুষ কী সুখে যে হাটে!
হালটে ওঠে আলতা বলল, শীত করতাছে বাউলদাদা।
সোনাদাস বলল, আমার গায়ের কাপড়টা নিবি?
শুনে খিল খিল করে হেসে ওঠল আলতা, আমারে যে গায়ের কাপড় দিবা বাউলদাদা, তোমার শীত লাগব না?
লাগুক।
না থাউক, তুমি বড় মানুষ। শীতে কষ্ট পাওনের কাম নাই! আমারে একখান বিড়ি দেও।
অন্য সময় হলে সোনাদাস দিত না। আজ মন ভালো। নগদ দশ টাকা রোজগার হয়েছে। সেও আলতার জন্যেই। সেই আলতাকে একটা বিড়ি দিলে কী এমন ক্ষতি! দেয়, সোনাদাস একটা বিড়ি বের করে দেয় আলতাকে।
আলতা বলল, ধরাইয়া দেও।
সোনাদাস ধরিয়ে দেয়। তখন কাছে কোথায় একটা রাতপাখি ডেকে ওঠে। আর দূরে বাজারের দিকে ঘেউ দেয় একটা কুকুর।
বিড়ি টানতে টানতে আলতা বলল, কথাবার্তা কও বাউলদাদা, চুপচাপ আটতে ভাল্লাগে না।
সোনাদাস বলল, কি কমু ক?
একটা কিচ্ছা কও।
আমি কিচ্ছা জানি না বইন।
তয় তোমার নিজের কথা কও।
আমার নিজের আবার কি কথা?
কত কথা থাকে না মাইনষের। সুখের কথা, দুঃখের কথা।
আমার সুখও নাই, দুঃখও নাই।
সুখ দুঃকু ছাড়া মানুষ আছেনি?
আছে।
কেডা আছে কও তো!
সোনাদাস হেসে বলল, এই যে আমি আছি।
বিড়িতে টান দিয়ে আলতা বলল, ধুৎ। বিতলামি কইর না বাউল দাদা কও।
কি কমু?
তুমি বিয়া কর নাই ক্যা? বলে আলতা আবার হাসে।
হাসতেও পারে মাগি। সোনাদাসের একটু রাগ হয়। কিন্তু রাগটা চেপে রাখে। আলতার সঙ্গে রাগারাগি করলে লোকসান। বাবুকে যদি বলে দেয়!
আলতা বলল, কী অইল, কথা কওনা ক্যা? আমি কইলাম তাইলে যামু না!
আলতার কথা শুনে ভয় পায় সোনাদাস। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কেমনে বিয়া করুম। আমারে মাইয়া দিব কেডা?
ক্যা! মাইয়া দিব না ক্যা!
কেমনে দিব ক। কী আছে আমার!
তোমার কোনও পিরিতের মাইয়ামানুষ আছিল না?
না। আমার লগে পিরিত করব কেডা? দুনিয়ায় কেউ নাই আমার। মা নাই, বাপ নাই। জন্মাইয়া চক্ষে কেউরে দেহি নাই। ফকিরফাঁকরা মানুষ, ভিখ চাইয়া খাইতাম। বুড়াকালে ভিখ মাইনষে দেয় না। বাবু দয়া না কললে মইরা পইড়া থাকতাম বাজারে। আলতা তারপর আর কোন কথা বলেনি।
সে রাতটার কথা এখনও মনে আছে সোনাদাসের। বেপারি লোকটা সারারাত আলতাকে নিয়ে তার বিছানায়। আর বাজারের নেড়ি কুত্তাটার সঙ্গে সুলতানের দোকানের সামনে, চারখানা বাঁশের খুঁটির ওপর বিঘত পরিমাণ চওড়া তক্তা ফেলে যে বেঞ্চ পাতা হয়েছে সেই বেঞ্চে বসে থাকল সোনাদাস। বসে বসে বিড়ি টানল। ওদিকে বৃষ্টিবাদলায়, অন্ধকারে গগনবাবুর গদিতে রাতভর বেপারির নাও থেকে বস্তা বস্তা ধান তুলল মাল্লারা। রাতের বেলা গদিতে কখনো মাল তোলেনি গগনবাবু। সেবার তুলেছিল কেন? পরদিন গগনবাবু বলেছিল, রাইতে গদিতে মাল ওঠাইছি কেউরে কইছনা সোনা। চব্বিশ ঘন্টায় নগদ কুড়ি টাকা কামাই! সোনাদাসের বড় সুখের দিন ছিল সেটা।
বলেনি, কথাটা কাউকে বলেনি সোনাদাস। অনেককাল পর শুনেছিল, চোরাই মাল ছিল ওগুলো। মাঝিমাল্লা আর মহাজনকে খুন করে হাজারমণি নাওটা নিয়ে ভেগে এসেছিল ওই বিলাইচোখো লোকটা! কিন্তু গগনবাবুর কিছু হয়নি। দুদিনের মধ্যে মাল বেচা শেষ। কত কামিয়েছিলেন সেবার কে জানে।
মনে আছে, সোনাদাসের সব মনে আছে। কিন্তু সোনাদাস এসব কথা কাউকে বলে না। বললে লোকসান, গগনবাবু তাড়িয়ে দেবেন। তখন সোনাদাস এই বুড়ো বয়সে কোথায় যাবে! কার কাছে যাবে! তার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।