মাইনকা কিন্তু জেগেই ছিল। দোকানের একটা ঝাঁপ আলগা করে হারিকেনের আলোয় ক্যাশবাক্স খুলে বসেছে। পয়সাপাতির হিশেব করছে। বাজারের একটা নেড়িকুত্তা টিনের ছনছার তলায় কুণ্ডলি পাকিয়ে বৃষ্টি থেকে গা বাঁচাচ্ছে। সোনাদাসের পায়ের শব্দ পেয়েও মাথা তুলল না।
সোনাদাসকে দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসল মাইনকা, কী খবর বাউল দাদা?
সোনাদাস বলল, কর্তায় দুই কাপ চা দিতে কইছে।
এত রাইতে কর্তার ঘরে আবার কেডা আইল?
সোনাদাস বলল, বেপারি আইছে।
মাইনকা গেলাসে চটপট চা তৈরি করে ফেলল। কালাকুষ্টি একখানা চামচ দিয়ে ফটাফট নেড়েচেড়ে সোনাদাসের হাতে দিল। বলল, কাপ দুইখান কাইল বিয়ানে দিলেই অইব বাউল দাদা।
আইচ্ছা দিমুনে।
সোনাদাস চা নিয়ে পায়ে পায়ে আড়তে ফিরে আসে।
চা খেতে খেতে গভীর মনোযোগ দিয়ে নিচু গলায় কী কী সব আলাপ করেন গগনবাবু। লোকটা বার তিনেক গলা খুলে হাসে। তারপর বলল, তাড়াতাড়ি পাড়ান। রাইত অইতাছে। বিষ্টিবাদলার দিন।
গগনবাবু বললেন, পাডাই আর একটু নিটাল হোক। যাইতে আইতে সময় লাগব না!
তা লাগব।
গগনবাবু আবার সোনাদাসকে ডাকেন, সোনা আর একটা কাম করতে অয় যে।
বাবুর ফুটফরমাস খাটতে সোনাদাস তো মুখিয়ে থাকে। ঝড়বাদলা যতই হোক, রাতবিরাত যতই হোক, গগনবাবুর কাজ করতে সোনাদাসের কোনও ক্লান্তি নেই।
সোনাদাস বলল, কন।
বাবু গদি থেকে নেমে এলেন। বেপারি লোকটা তখন সিগ্রেট ধরিয়েছে।
বাবু ফিসফিসে গলায় বললেন, আলতারে আনতে পারবি?
সোনাদাস মুহূর্তমাত্র দেরি করল না। খুবই সরল গলায় বলল, আপনে কইলে পারুম না হেমুন কাম আছে!
বাবু খুশি হন, তয় যা। কবি, হারা রাইত থাকতে অইব।
কই থাকব?
তর বিছানায়।
কয়জন?
বেপারি একলাই।
গগনবাবু একটা দশ টাকার নোট গুঁজে দেন সোনাদাসের হাতে।
এইডা আগাম দিলাম। নাইলে তো আবার আইতে চাইব না! মাগির তো আইজকাল দাম বাইড়া গেছে!
টাকাটা হাতে নিয়ে বেরোয় সোনাদাস। বৃষ্টিটা তখন একটু কমে এসেছে। বড় ফোঁটাগুলো নেই। ঝির ঝির করে, ধুলো জমে থাকা উঠোন ঝাড় দেয়ার আগে বাড়ির বউঝিরা নরম হাতে কখনও কখনও যেমন জল ছিটায়, তেমন করে বৃষ্টিটাও যেন ছিটিয়ে দিচ্ছে কেউ। বাতাসটা আছে। কনকনে ঠাণ্ডা। গায়ের নুনছাল ফুটো করে ভেতরে ঢুকে যায়।
শীত করে, বড় শীত করে সোনাদাসের। কাঁপতে কাঁপতে অন্ধকারে পথ ঠাওর করে হাঁটে সে। মাথায় ডোঙা নাওয়ের মতন বস্তাটা আছে, গায়ে আছে চাদরখানা। তবু বৃষ্টি মানে না, শীত মানে না। হলে হবে কি, গগনবাবু বলেছেন, না গিয়ে উপায় কী! সোনাদাস হাঁটে। অন্ধকারে পথ ঠাওর করে হাঁটে।
আজ রাতের ঘুমটা মাটি। সারারাত কেচ্ছাকেলেঙ্কারি হবে আড়তে, সোনাদাসের বিছানায়। গগনবাবু অবশ্য ওসবে নেই। বয়স হয়েছে, কাম মরেছে বহুকাল আগে। বেপারির কাছ থেকে সস্তায় মালটা নেবেন। কিন্তু সোনাদাসের লাভটা কী?
আছে, লাভ সোনাদাসেরও আছে। গগনবাবু তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, থাকার জায়গা দিয়েছেন। ফুটফরমাস খাটলে চালটা পয়সাটাও দেন। সুযোগ পেলে সোনাদাস চুরি চামারিও করে কিছু। গগনবাবু টের পান না। হাজার হাজার মণ চাল থাকে গদিতে। কোণাকানছি কুড়িয়েই চলে যায় সোনাদাসের। একলা মানুষ, বয়েস হয়েছে, কাজকাম নেই, এককালে বাজারে বাজারে গান গেয়ে ভিখ মাগত। নামের সঙ্গে বাউল যোগ হল, দিন চলে যেত। এখন বয়েস ভাটির দিকে, গলা দিয়ে সুর ওঠে না। গান শুনে লোকে ভিখ দেয় না। হাসে। গালাগাল করে।
আলতাদের বাড়ির কাছাকাছি আসতেই মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল সোনাদাসের। তক্তি বিস্কুটের মতো দশ টাকার একখানা নোট দিয়েছেন বাবু। একদম মুরমুরে। নোটটা জামার বুক পকেটে রেখেছে সোনাদাস। এই টাকাটা আলতাকে দিতে হবে। না দিলে হয় না।
সোনাদাসের মাথায় মাকড়শার মতো জাল বিস্তার করে বুদ্ধি। আলতাকে পায়েহাতে ধরে নিয়ে যাবে সোনাদাস। বাবু আগাম টাকা দিয়েছেন একথা আলতাকে বলবেই না। সকালে ফেরার সময় তো আরো টাকা দেবেন গগনবাবু। কমপক্ষে দশ টাকা দেবেন। তাতেই খুশি হয়ে যাবে আলতা, টু শব্দটা করবে না। বুঝতেই পারবে না আগাম আরো দশ টাকা দিয়েছিলেন বাবু। টাকাটা সোনাদাস হজম করে ফেলেছে।
খুশিমনে বিড়ি বের করে সোনাদাস দেশলাই জ্বেলে কায়দা করে ধরায়। যদি ধরা পড়েই যায়, তখন দেখা যাবে। বাবুকে বলবে, আলতা আগাম চায়নি। আলতাকে বলবে, টাকাটা যে জেবে রাখছি ভুইলাই গেছিলাম।
আর যদি ধরা না পড়ে।
এই অব্দি ভেবে চাদরের তলা দিয়ে জামার বুক পকেটে হাত দিয়ে টাকাটা একবার ছুঁয়ে দেখে সোনাদাস। হাতটা গরম হয়ে যায়। টাকা বড় গরম জিনিস। আগুনের মতন।
সোনাদাস হাঁটতে থাকে। খুশিমনে হাঁটতে থাকে।
.
আলতাদের বাড়িটা গ্রামের মুখেই। হাটের ধারে। বাড়ি বলতে একটা মাত্র ছনের ঘর, গোটাকয় কলাগাছ আর চার কদম খোলা জায়গা। সংসারে আলতা আর বুড়ি মা ছাড়া আর কেউ নেই। কচি বয়সে মাতবর চরের এক চউরা লাঠিয়ালের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল আলতার। পদ্মায় নতুন চর জাগলে মহাজনদের হয়ে চর দখল নিতে যেত। চর দখল নিতে গিয়েই মরল। আলতার তখন গা গতরে ভরা যৌবন, পদ্মার জোয়ারের মতন। কী করবে, খসম হারিয়ে মেয়েমানুষটা গেল বেশ্যা হয়ে। একদিকে পেটের দায়, অন্যদিকে শরীরের। এখন দিনের বেলা এ বাড়ি ও বাড়ি দাসীবান্দির কাজ করে, আর রাতের বেলা করে বেশ্যাগিরি। বাজারের কোন না কোন ঘরে রাত কাটে আলতার। ভগবান বড় সহায় আলতার। পেটটা দিয়েছে বাজা করে। নইলে বছর বছর বিয়াত, শরীরখানা যেত ধেরধের হয়ে। লোকে নগদ পয়সা দিয়ে আলতার সঙ্গে শুত না। আলতার কথা সব জানে সোনাদাস। একদিন দুঃখের কথা সব সোনাদাসকে বলেছিল আলতা। সোনাদাসের কী করার আছে, সেও তো জনম দুঃখী। জন্মের পর আপন বলতে কাউকে দেখেনি। দেখেছে এই বাজারটা। বাজারটাই তার একমাত্র আপনজন। হাঁটতে হাঁটতে, এসব ভাবতে ভাবতে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল সোনাদাসের।