গগনবাবু বনেদি ঘরের মানুষ। চক্রবর্তী। গগনবাবুদের বাড়ি ছিল মালখানগর। মালখানগর খুবই বিখ্যাত জায়গা। বিক্রমপুরের সব বনেদি হিন্দুদের বাস ছিল মালখানগরে। বোসের বাড়ি, প্রবাদ আছে ঐ বাড়িতে বাহান্নটা গলি ছিল। পার্টিশানের পর বোসরা চলে গেল হিন্দুস্থান। গগনবাবুদের বাড়ি ছিল বোসের বাড়ির কাছেই। পার্টিশানের পর ছেলেমেয়ে, বউ সব কোলকাতা পাঠিয়ে দিলেন গগনবাবু। নিজে পড়ে রইলেন এদেশে। লৌহজং বাজারে পৈতৃক আড়ত। ধানচালের কারবার। বেদম টাকা পয়সা ছেড়ে যেতে রাজি হলেন না। এখন লোকে বলে, গোছগাছ করে গগনবাবুও একদিন চলে যাবেন। এদেশে পড়ে থাকা অবস্থাপন্ন হিন্দুদের এটাই নাকি নিয়ম।
কথাটা গগনবাবু স্বীকার করেন না। বলেন, এদেশ ছাইড়া আমি যামু না। জন্মাইছি এই দেশে, বড় অইছি এই দেশে, এইডা আমার দেশ। এই দেশ ছাইড়া আমি যামু ক্যা! যামু না। বড় মায়া লাগে।
সোনাদাস জানে মুখে মধুমাখা মানুষটার। কথায় দুনিয়া জয় করেন। গগনবাবুর সঙ্গে একবার কথা বলে কোনও বেপারির আর ক্ষমতা নেই অন্য কোনও আড়তদারের কাছে মাল বেচে। পয়সার জন্যে সব করতে পারেন গগনবাবু! জানে, সোনাদাস সব জানে। কিন্তু জেনে হবে কী! সোনাদাস কাউকে বলে না। চেপে থাকে। বলে লাভটা কী! গগনবাবু চটে যাবেন। গগনবাবু চটে গেলে সোনাদাসের থাকার জায়গাটা যাবে, অভাবের দিনে চালটা নগদ পয়সাটা যাবে। সোনাদাসের উপায় হবে কী? গগনবাবু দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলে সোনাদাসের মাথা গোঁজার ঠাঁই থাকবে না। বুড়ো বয়সে সোনাদাস যাবে কোথায়। নইলে এই আড়তের ভেতর কম কীর্তিকলাপ তো ঘটে না!
সোনাদাস সব দেখে, চোখ খুলে দেখে। কান খুলে শোনে। আর চুপচাপ বিড়ি টানে। দেখেও না দেখার ভান করে, শুনেও না শোনার ভান করে। সোনাদাসের কোন উপায় নেই। গেল বর্ষায় ধান নিয়ে এল ভাটির এক বেপারি। চেহারাসুরৎ ডাকাতের মতো। গগনবাবুর পুরনো লোক। সোনাদাস আগেও দুএকবার মানুষটাকে দেখেছে। ঠোঁটের ওপর পাকানো গোঁফ, মাথায় ঝাঁকড়া চুল। চোখ দুটি বেড়ালের চোখের মতো কুকুতে। হলে হবে কী, ভারি ধার চোখে। কারো দিকে ভালো করে তাকালে বুক কেঁপে যাবে সেই মানুষের।
লোকটা এল এক সন্ধ্যায়। সেদিন সকাল থেকে ধুম বৃষ্টি। দোকানিরা দোকানপাট বন্ধ করে দিয়েছে বিকেলবেলাই। দুএকটা মুদিমনোহারি দোকানে টিমটিম করে হারিকেন জ্বলছিল। সন্ধ্যার মুখেই খাওয়াদাওয়া সেরে ফেলেছিল সোনাদাস। বসে বসে বিড়ি টানছিল। গদিতে বসে লাল রঙের একখানা খেরো খাতা খুলে গগনবাবু মনোযোগ দিয়ে হিসেব লিখছেন। গায়ে পঞ্চাশ বছরের পুরনো একখানা শাল। বৃষ্টিতে দুনিয়া ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। থেকে থেকে দমকা একটা বাতাসও দিচ্ছে। টিনের ঘরটার ফাঁকফোকর দিয়ে হুহু করে আসছে বাতাস। সোনাদাস শীত টের পাচ্ছিল। এ সময় এল মানুষটা। বাইরে দাঁড়িয়ে হাঁক দিল, বাবু আছেননি? গগনবাবু খাতা থেকে মুখ না তুলেই বললেন, কেডা?
বেপারি!
গগনবাবু খাতাপত্র বন্ধ করে বললেন, আসেন।
লোকটা কাঠের ভেজানো দরোজা ঠেলে ঘরে ঢুকল। ঢুকেই দুহাত বুকের কাছে তুলে যাত্রাদলের নায়কের মতো বলল, নমস্কার দাদা।
ততক্ষণে গগনবাবু পারলে লাফিয়ে ওঠেন। আরে কী সৌভাগ্যি! আসেন আসেন। দুহাতে গদির শাদা ফরাশ ঝাড়তে লাগলেন গগনবাবু। বসেন বেপারি, বসেন।
লোকটা বিনীতভাবে বসল। ঘরের চারদিকে বেড়ালের মতো ঝকঝকে চোখ তুলে একবার তাকাল। সোনাদাস ছিল ধানচালের বস্তার আড়ালে, নিজের ছালার বিছানায়, ঝোপঝাড়ের মতন হাটু গুঁজে বসে। জায়গাটায় অন্ধকার থক থক করছে। অদূরে গগনবাবুর গদিতে টিমটিম একখানা হারিকেন জ্বলছিল। তার মৃদু একটা আলো ছড়িয়ে আছে খানিকটা জায়গা জুড়ে। কিন্তু সোনাদাসের বিছানা অব্দি আলো পৌঁছায়নি।
অন্ধকারের আড়াল থেকে গলা বাড়িয়ে লোকটাকে একবার দেখে সোনাদাস। বিড়ি শেষ হয়ে আসছিল। সুখটান দিয়ে বেড়ার ফাঁক দিয়ে বিড়ির শেষাংশ গলিয়ে দিল সোনাদাস। তখনই গগনবাবু ডাকলেন তাকে। সোনা, এদিকে আয়। বেপারিরে চা খাওয়া।
সোনাদাস আড়মোড় ভেঙে ওঠল। অনেককালের পুরনো, ছেঁড়াখোঁড়া একখানা চাদর ছিল, শীতকালে গায়ে দেয়। মাথার কাছেই চাদরটা থাকে, টেনে নিল সোনাদাস। তারপর আস্তেধীরে গগনবাবুর গদির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। লোকটা তখন খুবই আয়েশ করে বসেছে। গদিতে একেবারে পা তুলে। খুব নিচু গলায় কী কী সব আলাপ করছিল। সোনাদাসকে দেখে থেমে গেল। গগনবাবু বললেন, মাইনকারে ক, দুইকাপ ফাসকেলাস চা দিতে।
দরোজার আড়াল থেকে বৃষ্টির জোর দেখে সোনাদাস। ধুমসে পড়ছে। এসময় মাইনকা কি দোকান খুলে বসে আছে। থাকলেই বা ফায়দা কী। খদ্দের পাবে কোথায়।
সোনাদাস বলল, মাইনকার দোকান মনে অয় বন্ধ কর্তা।
শুনে বেপারি লোকটা বলল, থাউক, চা লাগব না।
গগনবাবু হা হা করে ওঠলেন, মাইনকারে গিয়া ডাইকা ওঠা, আমার কথা ক।
সোনাদাস আর কথা বলে না, অন্ধকারে বৃষ্টির মধ্যে নেমে যায়। বৃষ্টির সঙ্গে হাওয়াটা ছিল। সরাসরি পদ্মা থেকে আসছে। কী ঠাণ্ডা! চাদর ফুটো করে সোনাদাসের শরীরের ভেতর ঢুকে যাচ্ছিল। বৃষ্টি তো আছেই। সোনাদাস একখান আড়াইমণি খালি বস্তা ডোঙা নাওয়ের মতন করে বৃষ্টিবাদলায় ব্যবহার করে। বেরুনোর সময় মনে করে, সেটা মাথায় দিয়েছিল, তবু বৃষ্টির ছাঁট মুখে লাগছিল সোনাদাসের।