আগেই তো কইলাম আমগ দেশ গেরামের পোলাপানের মতনই মনে হইতাছে।
তার মানে কী! আমরা এদেশের মানুষ। বাংলার মানুষ। বাংলায় কথা বলি।
জ্বে।
আর মিলিটারিরা?
তারা তো হুনছি অন্য ভাষায় কতা কয়। অন্য দেশের মানুষ।
হ্যাঁ, তারা অন্য দেশের মানুষ। বহু দূরদেশ থেকে এসে দখল করতে চাইছে এই দেশ।
জ্বে?
হা। তবে এসবের ভেতর অনেক কথা আছে, অনেক প্যাঁচ আছে। অতসব তুমি বুঝবে না। খুব সহজ কথায় তোমাকে দুএকটি ব্যাপার বুঝাই আমি। ধর তুমি একটা জমির মালিক। চাষবাস করে তুমি তাতে ফসল ফলাও। ফসল পাকলে অন্য গ্রামের কিছু লোক এসে ফসলটা ছিনিয়ে নিয়ে যায়, তুমি তখন কি করবে?
নিজামের চোখ দুটো ধ্বক করে জ্বলে ওঠল। জান থাকতে ফসল নিতে দিমু মনে করেন। মইরা যামু, শহীদ হইয়া যামু তাও ফসল নিতে দিমু না।
মিলিটারিরা হচ্ছে ওরকম কিছু শয়তান। অন্য দেশ থেকে এসে আমাদের দেশের সব সম্পদ ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের লোকজন মেরে শেষ করে ফেলছে। আমাদের মা বোনদের সর্বনাশ করছে। এজন্যে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি আমরা। এদেশ থেকে শয়তানদের তাড়াব আমরা। দেশ স্বাধীন করব।
চোখে পট পট করে কয়েকটি পলক ফেলল নিজাম। কন কি, মেলেটারিরা এই রকম? চেরমেন শুয়োরের বাচ্চায়তো তাইলে আমারে উল্টাপাল্টা বুজাইছে।
হা। এখন রাজাকার জিনিসটি কী তোমাকে আমি বোঝাচ্ছি। এদেশের যে সব শয়তান টাকার লোভে, ক্ষমতা এবং সম্পদের লোভে মিলিটারিদের পক্ষে কাজ করছে তারা হল রাজাকার।
তাইলে তো রজাকারও দেশের শত্রু। বেঈমান। বদ।
হ্যাঁ।
হায় হায় কিছু না বুইজা, পেটের দায়ে এইডা কী করছি আমি! রজাকার হইছি কেন? আমার মতন বেঈমান তো তাইলে কেউ নাই।
তুমি ভুল করেছ।
এমুন ভুল তো মাইনষের করন উচিত না। দেশের লগে বেঈমানি করন তো মানুষের কাম না!
বেঈমানির শাস্তি কী হওয়া উচিত? রাজাকারদের শাস্তি কী হওয়া উচিত এখন তুমিই বল। তুমি মুক্তিযোদ্ধা হলে রাজাকারদের কী শাস্তি দিতে?
দাঁতে দাঁত চেপে নিজাম বলল, মাইরা ফালাইতাম। একদম মাইরা ফালাইতাম। এক শালা রজাকাররেও বাঁচতে দিতাম না। দেশের মানুষ হইয়া দেশের লগে বেঈমানি!
রফিক শীতল গম্ভীর গলায় বলল, তোমাকেও আমরা মেরে ফেলব। খালপাড় নিয়ে গুলি করে তোমার লাশ ফেলে দেব খালের জলে। তোমার লাশ দেখে রাজাকাররা যেন ভয় পায়। অন্য কেউ যেন রাজাকার হওয়ার সাহস না করে।
সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে ওঠে দাঁড়াল নিজাম। দৃঢ় গলায় বলল, তয় আর দেরি কইরেন না। তাড়াতাড়ি আমারে খালপাড় নিয়া যান।
সোনাদাস বাউলের কথকতা
সোনাদাস থাকে বাজারের পেছন দিকে, গগনবাবুর ধানচালের আড়তে। আড়তের। ভেতর ধানচালের বস্তাগুলোর আড়ালে এক চিলতে ঠাণ্ডা মাটি। দুটো আড়াইমণি বস্তা। কেটে সোনাদাস সেখানে বিছানা পেতেছে। মাথার কাছে স্কুলবাড়ির দুখানা থান ইট। ইট দুখানা চুরি করেছিল সোনাদাস। সে গেল বছরের কথা।
গেল বছর বর্ষায় হাজারমণি গস্তি নাও ভরে স্কুলবাড়ির ইট এল ফতুল্লা থেকে। কদিন খুব ইট টানল কামলারা। থাক করে রাখল স্কুলবাড়ির মাঠে। বর্ষা যেতে না যেতেই গাঁথনি শুরু হল স্কুলের। এখন পেল্লায় একখানা দালান ওঠেছে মাঠের উত্তরে। পোলাপান বইখাতা বগলে নিয়ে সেই স্কুলে পড়তে যায়।
সোনাদাস ইট দুখানা চুরি করেছিল স্কুলবাড়ির মাঠ থেকে। থাক করে রাখা ছিল। এক সন্ধ্যায় ঘোড়দৌড় থেকে ফেরার পথে ভাও বুঝে দুবগলে দুখানা বাছা ইট নিয়ে আড়তে ফিরল। গগনবাবু তখন গদিতে হারিকেন জ্বালিয়ে বসে বিড়ি টানছেন। বেঞ্চিতে দুতিনজন বেপারি বসা। ভাটির নাও এসেছে ঘাটে। সেই নাওয়ের বেপারিরা এসেছে গগনবাবুর কাছে। পড়তা পড়লে মাল কিনবেন গগনবাবু। দরদাম করছেন। ধানের দাম খুব চড়া সেবার। বেপারিরা মুখ ভার করে রেখেছে। গগনবাবুর দিকে তাকায় না।
তবে গগনবাবু ঘাঘু লোক। মুখে মধুমাখা মানুষটার। বাজারের আর তিনজন আড়তদারের তুলনায় গগনবাবু বরাবরই সস্তায় মাল কেনেন। বেপারিদের বিড়িটা সিগারেটটা খাওয়াবেন। ধুম খাতির হয়ে যাবে চোখের নিমিষে। দরদাম তো পরের কথা। আগে খাতির। ইয়ার দোস্তি। বাজারের সেরা মাছ কিনে খাওয়াবেন বেপারিদের। এসব নিয়ে অন্য আড়তদাররা অবশ্য কম কথা বলে না। কম টিটকিরি মারে না। গগনবাবু গায়ে মাখেন না। লোকের কথায় কী আসে যায়। কথা তো লোকে বলবেই! লোকের কাজই তো কথা বলা।
গগনবাবু নিজের কাজ করে যান। ব্যবসাদার মানুষ, ব্যবসা করে যান। ফলে বেদম টাকা আসে। আড়ত ভরা থাকে ধানচালে। বস্তার পর বস্তা। লোহার সিন্দুকে টাকার বাণ্ডিল সাজিয়ে ওমা মুরগির মতন বসে থাকেন গগনবাবু। আর বছর বছর টাকা পাচার করেন কোলকাতায়। সেখানে গগনবাবুর সংসার। ছেলেমেয়েরা আছে, মা-বাপ আছে, স্ত্রী আছে। তিনতলা বাড়ি কিনেছে। একদিন গগনবাবুও নাকি সব ছেড়েছুড়ে সেখানে চলে যাবেন।
তখন সোনাদাসের উপায় হবে কী!
সোনাদাস একদিন কথাটা তুলেছিল, কর্তায় বলে কইলকাত্তা চইলা যাইবেন? শুনে গগনবাবু বিড়ি টানতে টানতে বললেন, তরে কইল কেডা?
বাজারের মাইনষে কয়।
মাইনষে তো কত কিছুই কয়।
গগনবাবু হাসলেন। হাসিটা ভারী সুন্দর মানুষটার। তিন কুড়ির ওপর বয়স। একটাও দাঁত পড়েনি এখন। রোজ নিমের ডাল দিয়ে দাঁত মাজেন। হাসলে ঝিলিক দেয় দাঁত। মাথায় চকচকে টাক গগনবাবুর। অল্প কিছু চুল আছে। কাশফুলের মতো শাদা আর পাতলা। নদীর হাওয়ায় ফুর ফুর করে ওড়ে। গায়ের রঙটাও বেশ ঘষামাজা গগনবাবুর। শরীর থলথলে মোটা। সাদা ধুতি আর হাতাঅলা গেঞ্জি পরে থাকেন। গলায় পৈতে।