মজনু বলল, তুমি চোর না চোরের বাপ। রাজাকার।
রজাকার হইছি কী হইছে! মানুষ রজাকার হয় না?
শুনে হো হো করে হেসে ওঠল সবাই।
বাচ্চু বলল, শালা নিজেদের নামটা পর্যন্ত ঠিকমতো বলতে পারে না। রাজাকারকে বলছে রজাকার।
রফিক গম্ভীর গলায় বলল, আস্তে। এখন আর কোনও হাসিঠাট্টা নয়। আমি কথা বলব। সঙ্গে সঙ্গে স্তব্ধ হয়ে গেল সবাই।
লোকটির চোখের দিকে তাকিয়ে রফিক বলল, নাম কি?
লোকটি খ্যাক খ্যাক করে হাসল। এইবার কওন যায়। তার আগে কন আপনেরা কারা? বেবাকতের লগে বন্দুক, ডাকাইতের লাহান চেহারা। ডাকাইত হইলে আমারে ধরছেন কেন? মাইরা ফালাইলেও চাইর আনা পয়সা দিতে পারুম না। আমি পথের ফকির। ভাত জোটে না দেইকা রজাকার হইছি। সত্য কইরা কন আপনেরা কারা?
রফিক কথা বলল না। আস্তে করে চেয়ার ঠেলে ওঠল। নরম ভঙ্গিতে গিয়ে দাঁড়াল লোকটির সামনে। তারপর কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুহাতে প্রচণ্ড দুটো চড় মারল লোকটির দুগালে। আমরা তোর যম শুয়োরের বাচ্চা। মুক্তিযোদ্ধা।
হঠাৎ করে এমন দুখানা চড় খেয়ে খুবই দিশেহারা হয়ে গেল লোকটি। তবু মুক্তিযোদ্ধা কথাটা শুনে ফ্যাল ফ্যাল করে রফিকের মুখের দিকে তাকাল। অবাক গলায় বলল, আপনেরা মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিবাহিনী! দেখতে তো আমগ দেশ গেরামের পোলাপানের লাহানই। আমি তো মনে করছিলাম মুক্তিবাহিনী না জানি কেমুন দেখতে!
এবার লোকটির তলপেট বরাবর প্রচণ্ড একটি লাথি মারল রফিক। আবার কথা!
লাথি খেয়ে বেশ কাবু হল লোকটি। কাঁদো কাঁদো মুখ করে রফিকের দিকে তাকাল। কিন্তু ভয়ে আর কথা বলল না।
চেয়ারে বসে রফিক বলল, নাম কি?
লোকটি ভয়ে ভয়ে বলল, নিজাম।
কতদিন হল রাজাকার হয়েছ?
এক মাস বারদিন।
কেন হয়েছ?
পেটের দায়ে।
পেটের দায়ে কথাটা শুনে ঘরের ভেতরকার প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা স্তব্ধ হয়ে গেল।
নিজাম ঢোক গিলে বলল, ছোড ছোড চাইরডা পোলাপান লইয়া না খাইয়া থাকি। দেশ গেরামে কোনও কাম নাই। চাইর দিকে গণ্ডগোল।
রফিক বলল, আগে কি করতে?
কামলা দিতাম। মাইনষের খেতখোলায় ধান কাটতাম, পাট কাটতাম, খেত চষতাম। ফসলের মাস না হইলেও গেরস্ত বাড়িত নানান পদের কাম আছিল। খাইয়াপইরা বাঁচতাম। অনেকদিন ধইরা দেশ গেরামে কোনও কাম নাই। পেট চলে না। খিদায় পোলাপানডি রাইতদিন কান্দে।
রাজাকার হওয়ার বুদ্ধি কে দিল তোমাকে?
চেরমেন সাবে।
তার কাছে গিয়েছিলে কেন?
কামকাইজের আশায়। বিপদে পড়লে দেশ গেরামের মানুষ চেরমেনের কাছেই যায়। গিয়া কাম চাইলাম, কইল ভালো কাম আছে, কর। তারবাদে রজাকারিতে লাগাইয়া দিল।
একাজে কি তোমার পেট চলছে?
হ তা চলতাছে। নাম লেখানোর লগে লগে একশো টেকা দিল কমন্ডর সাবে। দিয়া কইল বাড়িতে বাজার কইরা দে। তারবাদে টেরনিং হইব।
ট্রেনিং হয়েছে?
না অহনতরি হয় নাই। লুঙ্গিগেঞ্জি দিছে, শীতের কাপড় দিছে, জুতা দিছে হেইডি পিন্দা, বাঁশের একখান লাডি হাতে লইয়া বাজারে ঘুইরা বেড়াই, গুদারা ঘাডে যাই, মুক্তিবাহিনী আছেনি, সম্বত লই। তয় মুক্তিবাহিনীর খালি নামই হুনছি, আইজ পয়লা চোখে দেখলাম।
মিলিটারি দেখেচ?
না। আমগ কমন্ডর সাবে দেখছে। তার লগে মেলেটারিগ খুব খাতির। আমরা হইলাম ছোড রজাকার আমরা তাগ দেখুম কই থিকা।
নিজামের কথা বলার ধরন বেশ আন্তরিক। প্রিয়জনদের কাছে সুখ-দুঃখের গল্প করার ভঙ্গিতে কথা বলছে সে। মুক্তিযোদ্ধারা স্তব্ধ হয়ে তার কথা শুনছে। তারা বুঝে গেছে এই সরল গ্রাম্য লোকটি একটিও মিথ্যে কথা বলছে না।
রফিক বলল, তোমাকে রাইফেল দেয়নি কেন?
নিজাম বলল, কমন্ডর সাবে কইছে আরও পরে দিব। আমি আর একটু চালু হইলে। আবার নাও দিতে পারে। সব রজাকাররে রাইফেল বন্দুক দেয় না। কিছু ফালতু রজাকারও আছে। আমি হইলাম ফালতু। তয় রজাকার হইয়া আমি বেদম সুখে আছি সাব। চাইল আটা পাই, টেকাপয়সা পাই। পোলাপানডি অহন আর খিদায় কান্দে না।
এক দেড়মাসে আমার চেহারাসুরত ভালো হইয়া গেছে।
একটু হেসে ভয়ে ভয়ে নিজাম বলল, আপনেগ কেউর কাছে বিড়ি হইব সাব! মাইর ধইর খাইয়া ভয়ে ভয়ে গলা শুকাইয়া গেছে। বিড়ি টানলে কথা কইতে সুবিধা।
রফিক তার বুকপকেট থেকে সিগ্রেটের প্যাকেট বের করল। একটা সিগ্রেট ছুঁড়ে দিল নিজামের দিকে। ম্যাচ দিল। নিজাম সিগ্রেট ধরিয়ে ফুক ফুক করে দুটো টান দিল। তারপর মাটিতে আয়েশ করে বসল। একটু আরাম কইরা বহি সাব। বইয়া বিড়িডা খাই।
রফিক বলল, তাহলে তুমি পেটের দায়ে রাজাকার হয়েছ?
নিজাম সঙ্গে সঙ্গে বলল, হ সাব। আর কোনও কারণ নাই।
রাজাকার হওয়ার আর কি কি কারণ থাকতে পারে তুমি জান?
না সাব।
মিলিটারি কাকে বলে, মুক্তিযোদ্ধা কাকে বলে জান?
জানি। মেলেটারিরা হইল এই দেশের মালিক আর মুক্তিবাহিনীরা হইল
কথাটা শেষ না করে থেমে গেল নিজাম। ভয়ে ভয়ে রফিকের মুখের দিকে তাকাল। কমুনা সাব। আপনেরা মুক্তিবাহিনী। কইলে আপনেরা আমারে মাইরা ফালাইবেন। তয়। এত কিছু আমি বুজতাম না। আমি বুজতাম খালি পেডের খিদা। চেরমেন সাবে এইসব আমারে বুজাইছে।
তোমাকে ভুল বুঝিয়েছে।
অইতে পারে। চেরমেন সাবে বহুত মিথ্যা কথা কয়। আমরা সাব গরিব মানুষ। কিন্তু মিছা কথা কই না।
আমরা মুক্তিযোদ্ধা, আমাদেরকে দেখে তোমার কী মনে হচ্ছে?