স্কুলঘরটির ভেতর অদ্ভুত এক নির্জনতা। বাইরে দ্রুত ফুরিয়ে আসছে নভেম্বরের বিকেল। মৃদু শীত এবং অন্ধকার একাকার হয়ে এমন এক আবহ তৈরি করেছে ঘরের ভেতর যে আবহে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসার কথা মানুষের। বিশেষ করে অপরাধীদের। কিন্তু লোকটি নির্বিকার। খানিক আগেও চোখ বাঁধা ছিল, হাতদুটো এখন বাঁধা। দুপাশে রাইফেল কাঁধে দুজন মুক্তিযোদ্ধা, সামনে চেয়ার টেবিল নিয়ে বসা একজন, টেবিলের ওপর, হাতের কাছে রাখা একটি স্টেনগান। এসব দেখে যতটা ভয় পাওয়ার কথা তার ততটা ভয় সে পেয়েছে কিংবা পাচ্ছে বলে মনে হয় না। বরং তার চোখেমুখে চাপা একটা কৌতূহল। মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তিন মুক্তিযোদ্ধার দিকে তাকাচ্ছিল সে।
চেয়ারে বসা মুক্তিযোদ্ধার নাম রফিক। তার বয়স তিরিশের ওপর। রোদেপোড়া তামাটে মুখ। একদা যে সে বেশ ফর্সা ছিল মুখ দেখে বোঝা যায়। তার চোখ এখন ভাইরাস আক্রান্ত হয়নি। অন্য দুজন মুক্তিযোদ্ধার মতো তার চোখের কোণেও গাঢ় হয়ে জমেছে। কালি। তবে চোখের কালি ছাপিয়েও তার তীক্ষ্ণ অভেদী চাহনি চোখে পড়ে। দৃষ্টিতে এক সঙ্গে অনেক কিছু খেলা করে তার।
অন্য দুজন মুক্তিযোদ্ধার মতো রফিকের মুখেও অনেকদিনের দাড়িগোঁফ এবং সে বেশ লম্বা। স্কুলঘরের হাতাঅলা চেয়ার ছাপিয়ে অনেক দূর উঠেছে তার দেহ। রফিক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লোকটিকে দেখছিল। কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাবে তার আগেই লোকটি খুব সরল গলায় বলল, আমারে বাইন্দা আনছেন কেন? আপনেরা কারা?
রফিক গম্ভীর গলায় বলল, চোপ। কোনও কথা বলবে না। যা জিজ্ঞেস করব শুধু তার জবাব দেবে। অতিরিক্ত একটি কথা বললে গুলি করে দেব। এটা কি দেখেছ?
টেবিলের ওপর রাখা স্টেনগান দেখাল রফিক। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার লোকটি খুব একটা ভয় পেল বলে মনে হল না। হাসি হাসি মুখ করে রফিকের দিকে তাকাল। আদুরে গলায় বলল, দেখছি। বন্দুক। কয়দিন পর আমিও এই রকম বন্দুক পামু। কমন্ডার সাবে কইছে।
সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল রফিক। চোপ। তোমাকে না বলেছি অতিরিক্ত কথা বলবে না। তা বলছেন!
তবে?
কিন্তু দুই একখান কথা তো না জিগাইয়া পারতাছি না। আমারে এমনে বাইন্দা আনছেন। কেন? আমার অপরাধ কি? আপনেরা কারা?
লোকটির দুপাশে দাঁড়ানো দুজন মুক্তিযোদ্ধার একজনের নাম মজনু আরেকজনের নাম বাচ্চু। বাচ্চু একটু আমোদে স্বভাবের। কথায় কথায় সুন্দর করে শব্দ করে হাসে। লোকটির কথা শুনে হেসে ফেলল সে। সঙ্গে সঙ্গে শীতল চোখে তার দিকে তাকাল রফিক। গম্ভীর গলায় বলল, বাচ্চু।
বাচ্চু বুঝে গেল এরপর রফিক ভাইর অনুমতি ছাড়া শব্দ করা যাবে না। পাথর হয়ে থাকতে হবে।
বাচ্চু পাথর হয়ে গেল।
লোকটির চোখের দিকে তাকিয়ে রফিক বলল, তোমার নাম কি?
লোকটি আহ্লাদি শিশুর মতো ঠোঁট ফুলাল। কইতে পারুম না। হাত বান্দা মানুষ কতা কইতে পারে!
নিজে খুবই গম্ভীর স্বভাবের মানুষ রফিক। সহজে হাসে না। কিন্তু এরকম কথা শুনলে কে না হেসে পারে! রফিকও হাসল। কিন্তু বাচ্চু কিংবা মজনু হাসল না। রফিকের আদেশ ছাড়া হাসা যাবে না। তবে তাদের দুজনেরই হাসির তোড়ে বুক ফেটে যাচ্ছিল। ব্যাপারটা বুঝল রফিক। সে একটু নরম হল। হাসিমুখে বাচ্চু এবং মজনুর দিকে তাকাল। হালকা কৌতুকের গলায় বলল, ভালো জিনিস ধরে এনেছিস। এই নিয়ে খানিক মজা করা যাবে। যুদ্ধের ফাঁকে খানিকটা মজাও দরকার। তাতে এনার্জি বাড়ে। নাসিরদের ডাক। মজাটা সবাই মিলে করি। তারপর খালপাড় নিয়ে যাব।
বাচ্চু উচ্ছল গলায় বল, ঠিক আছে।
তারপর বেরিয়ে গেল।
মিনিটখানেকের মধ্যে দশ বারজন মুক্তিযোদ্ধা এসে ঢুকল ঘরে। লোকটির চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়াল। রফিকের চেয়ে বয়সে সামান্য বড় হবে এমন একজন, নাম আজমত, লোকটির দিকে ইঙ্গিত করে বলল, নিয়ে যাব?
রফিক হাসিমুখে বলল, একটু পরে। তোমাদের ডেকেছি জিনিসটি দেখাবার জন্য। নাম জিজ্ঞেস করেছি বলল কইতে পারুম না। হাত বান্দা মানুষ কথা কইতে পারে?
শুনে হো হো করে হেসে উঠল সবাই। কিন্তু আজমত হাসল না। বলল, এভাবে কথা বলা কিন্তু চালিয়াতিও হতে পারে। রাজাকারদের তো চেন না। শালাদের চালিয়াতির কিন্তু সীমা পরিসীমা নেই।
রফিক কথা বলবার আগেই লোকটি ভুরু কুঁচকে আজমতের দিকে তাকাল। ঘেঁকুড়ে গলায় বলল, ও মিয়া শালা কারে কইলেন? আমারে?
আজমত একটু থতমত খেল। তারপর শীতল চোখে লোকটির দিকে তাকাল। হ্যাঁ তবে ভুল বলেছি। তুমি কারও শালা হওয়ার উপযুক্ত নও। তুমি একটা শুয়োরের বাচ্চা। পরিবেশ ভুলে ক্রোধে ফেটে পড়ল লোকটি। খবরদার গাইল দিবেন না। হাতটা বান্ধা নাইলে আপনেরে দেইখা লইতাম কেমনে দেন। সাহস থাকলে হাত ছাইড়া দেন, লাগেন আমার লগে।
রফিকের দিকে তাকিয়ে হাসল আজমত। তোমার অনুমানই ঠিক। এ এক জিনিস।
রফিক বলল, তাহলে হাতের বাঁধনটা খুলে দাও। মজা করি।
লোকটির হাতের বাঁধন খুলে দিল আজমত।
রফিক বলল, পালাবার চেষ্টা করো না। তাহলে আর খালপাড় অব্দি নেয়া যাবে না।
লোকটি কথাটা শুনল কি শুনল না বোঝা গেল না। সে তখন পালা করে একবার ডানহাত একবার বাঁহাত ডলছে। আর মুখে চুক চুক শব্দ করছে। ইস্! মানুষ মানুষরে এমনে বাইন্দা আনে! দেহেন তো হাত দুইডার কী করছেন! ও মিয়ারা আমি কি চোর যে আমারে আপনেরা বাইন্দা আনছেন?