এখানটায় এলে বরাবরই বিজ্ঞাপনটার দিকে তাকায় পিয়া। পিয়া কখনো রিকশার হুড ফেলে বসে না। হুডের ভেতর থেকেই গলা বাড়িয়ে বিজ্ঞাপনটা দেখে।
আজ বিজ্ঞাপনটার দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে যায় পিয়া। জায়গাটা লোকে গিজ গিজ করছে। কী হয়েছে ওখানে?
রিকশাওয়ালা বলল, আফা পাইনতে একটা মানুষের লাশ পইড়া রইছে। মাথাডা নাই। অল্প বয়েস। একখান নীল শার্ট পরা আর সাদা ফুলপেন।
শুনে পিয়ার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠে। ইচ্ছে করে নেমে একবার দেখে আসে। কিন্তু লোকের যা ভিড়। পিয়া এই ভিড়ের ভেতরে গেলে লাশ রেখে লোকে পিয়াকেই দেখবে।
পিয়ার দেখা হয় না। রিকশাঅলা জায়গাটা পেরিয়ে যায়।
পিয়ার তখন বুক কাঁপিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে। আহা, কোন মায়ের বুক যে খালি হয়ে গেল! কোন প্রেমিকের স্বপ্ন যে শেষ হয়ে গেল!
পাবলিক লাইব্রেরির সামনে এসে রিকশা ছাড়ে পিয়া। তৈমুর থাকলে এই এলাকাতেই থাকবে। হয়তো চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছে। কিংবা পাবলিক লাইব্রেরির সামনের বারান্দায় বসে আছে। কিংবা টিএসসিতে।
রোকেয়া হলের উল্টোদিক থেকে পাবলিক লাইব্রেরি এলাকায় ঢোকে পিয়া। সামনের মাঠে বসে আড্ডা দিচ্ছে কয়েকটি ছেলেমেয়ে। নেই, ওখানে তৈমুর নেই। পিয়া আস্তে ধীরে হেঁটে পাবলিক লাইব্রেরির সামনে যায়। নেই। তারপর শরীফ মিয়ার দোকানের দিকে। নেই, তৈমুর কোথাও নেই। পিয়ার খুব মন খারাপ হয়ে যায়। বুকের ভেতর নড়েচড়ে ওঠে কান্না। তৈমুর, এতকাল পর আমি এলাম তোমার সঙ্গে কি দেখা হবে না! পিয়া তারপর টিএসসির দিকে যায়। টিএসসির কাছাকাছি আসতেই দেখে রাস্তার ধারে লম্বা দড়ি থেকে সিগারেট ধরাচ্ছে তৈমুর। দেখে খুশিতে চেঁচিয়ে ওঠতে ইচ্ছে করে পিয়ার। তারপর কেমন করে যে রাস্তাটা পেরিয়ে আসে সে। এসে একদম তৈমুরের মুখোমুখি। তৈমুর পিয়াকে দেখে একটু চমকে ওঠে! তৈমুরের চেহারা অমন উদভ্রান্তের মতো কেন?
পিয়ার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, তৈমুর তোমার কী হয়েছে? তার আগে তৈমুর বলল, ও তুমি! দেখা হয়ে ভালোই হল। চল, কথা আছে।
ওরা তারপর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে যায়। পার্কের ভেতর ঢুকে অনেকটা দূর পেরিয়ে আসে। তৈমুর কোনও কথা বলে না।
দুপুরবেলার তীব্র রোদ ছিল চারদিকে। পার্কের গাছপালা থেকে উঠে আসছিল এক ধরনের উত্তাপ। একটা ঝোপের আড়ালে ছায়ায় ওরা বসে পড়ে। বসেই তৈমুর আবার সিগারেট ধরায়। তারপর অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে বলে, মন্টু খুন হয়েছে।
এ্যা!
কথাটা শুনে আপাদমস্তক কেঁপে ওঠে পিয়া।
হা! কাউরান বাজারের সামনে একটা পুকুরে মন্টুর লাশ পাওয়া গেছে। মাথা নেই। মন্টুর নীল শার্ট আর সাদা প্যান্ট দেখে চেনা গেছে।
আমি এখন তো ওখান দিয়েই এলাম। একটা পুকুরপাড়ে খুব ভিড় দেখলাম। রিকশাঅলা বলল একটা লাশ পড়ে আছে।
ওই আমাদের মন্টু।
তৈমুর আবার চুপ। দেখে পিয়ার বুকের ভেতর কেমন করে। হঠাৎ তৈমুরের একটা হাত জড়িয়ে ধরে পিয়া, তুমি এখন কী করবে?
ডিসিশন নিয়ে নিয়েছি। এ জন্যেই তোমার সঙ্গে আজ দেখা হওয়া দরকার ছিল।
তৈমুর আবার থেমে যায়। তারপর বলে, আজকের পর তোমার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না পিয়া। মা-বাবার কথায় রাজি হয়ে যাও। আমার পক্ষে কিছু সম্ভব নয়। কাল থেকে আমরা অন্যরকম এক জীবনে চলে যাব। মন্টুকে কারা খুন করেছে, খবর হয়ে গেছে। আমরাও ছাড়ব না শালাদের। তুমি আমাকে ক্ষমা কর।
এ কথায় পিয়া কি পৃথিবীর সবচে দুঃখী মানুষ হয়ে যায়? পিয়ার যে আজ কত কথা বলার ছিল। কিছুই বলা হল না। মনে রয়ে গেল মনের কথা।
তৈমুর বলল, তুমি বাড়ি যাও। আমাকে এখুনি যেতে হবে।
তৈমুর তারপর ওঠে দাঁড়ায়।
পিয়া বলল, একটু দাঁড়াও। তারপর তৈমুরের চোখের দিকে তাকায়। তাকিয়ে থাকে। পিয়ার চোখে কী ছিল কে জানে। তৈমুর হঠাৎ করে হাটু গেড়ে বসে পিয়ার সামনে। তারপর দুহাতে পিয়ার কোমর জড়িয়ে ধরে। তুমি আমাকে ক্ষমা কর, ক্ষমা কর।
পিয়ার কী যে হয়! একটুও কান্না পায় না। দুই করতলে তৈমুরের মুখ তুলে ধরে সে। তারপর আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায় তৈমুরের কপালে। তুমি ভালো থেকো তৈমুর। আমার কোনও কষ্ট হবে না।
লোকটি রাজাকার ছিল
চোখের বাঁধন খুলে দেয়ার পর বোঝা গেল লোকটি খুবই নির্বোধ ধরনের। জগৎ সংসারের অনেক খবরই সে রাখে না। চেহারায় অলস আয়েশি ভাব। মাথার চুল কদম ছাঁট দেয়া, কিন্তু রুক্ষ্ম নয়। তেল দিয়ে বেশ পরিপাটি করা। মুখের ঘন কালো দাড়ি গোফ যতনে ছাটা। চোখের কোণে বুঝি সুরমা ছিল, চেপে চোখ বাঁধার ফলে মুছে গেছে। পরনে হাতাঅলা কোরা গেঞ্জি আর নীল ডোরাকাটা লুঙি। গেঞ্জিলুঙি কোনওটাই খুব বেশি দিনের পুরনো নয়। হাত দুটো পিঠমোড়া করে বাঁধা। এ অবস্থায়ও সে যে বেশ দশাসই এবং তাগড়া জোয়ান বুঝতে কারও অসুবিধা হচ্ছিল না।
লোকটির দুপাশে দুজন মুক্তিযোদ্ধা দাঁড়িয়ে আছে। দুজনই অল্পবয়সী। বাইশ তেইশ বছর বয়স হবে। মাথায় রুক্ষ চুল ঘাড় ছাপিয়ে নেমেছে তাদের। ভাঙাচোরা মুখ অতিরিক্ত পরিশ্রমে চোয়াড়ে হয়ে গেছে। ভাইরাস আক্রান্ত চোখ লাল টকটকে। সেই চোখের কোণে গাঢ় হয়ে জমেছে কালি। দেখে বোঝা যায় একটি রাতও নিশ্চিন্তে ঘুমোয় না তারা। দুজনেরই কাঁধে রাইফেল। রাইফেল এবং তাদের শরীরের কাঠামো প্রায় একই ধরনের। একহারা, ঋজু। যদিও লোকটির দুপাশে তাদের দুজনকে অতিরিক্ত রোগা এবং ক্লান্ত মনে হচ্ছিল, তবু কাঁধের রাইফেল এবং তাদের শরীর মিলেমিশে এমন একটা রূপ নিয়েছে কোনটি যে কখন গর্জে উঠবে বোঝা যাচ্ছিল না।