কিন্তু হলে না গেলে তৈমুরকে নিবিড় করে পাওয়ার উপায় নেই। কিন্তু হলে যেতে তৈমুরের মানা। হলে কী কী সব কাণ্ড হচ্ছে বহুদিন ধরে। তৈমুরদের হলের কয়েকটি ছেলে আছে পাণ্ডামি করে বেড়ায়। ইউনিভার্সিটি ওদের ভয়ে কাঁপে। পকেটে রিভলভার নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। পুলিশ কিছু বলে না। সরকারি দল করে। পুলিশ ওদের ভাই। প্রয়োজনে পুলিশ সব রকমের সাহায্য করবে।
কিছুদিন আগে তৈমুরের পাশের রুমে কী একটা কাণ্ড ঘটে গেল। দুপুরবেলা একটা মেয়ে গেছে তার ক্লাসমেটের কাছে নোট আনতে। সামনে পরীক্ষা। গিয়ে হলের গেটে দাঁড়িয়ে স্লিপ পাঠিয়েছে ভেতরে। তক্ষুনি সুবোধ গোছের একটা অচেনা ছেলে এসে বলল, আপনি অমুকের কাছে এসেছেন? আমি ওকে চিনি। চলুন পৌঁছে দিচ্ছি।
মেয়েটি সরল বিশ্বাসে গেছে। তারপর, উ মাগো। ছেলেটি তার নিজের রুমে নিয়ে দরজা বন্ধ করেছে। তারপর একের পর এক দশ পনেরজন। মেয়েটির চিৎকারে সারা হল কেঁপে উঠেছে। কেউ সাহায্য করতে এগোয়নি। দরজার বাইরে খোলা রিভলভার হাতে পাহারায় ছিল চারজন। কে যাবে মরতে!
পিয়া শুনেছে মেয়েটি আর ইউনিভার্সিটিতে আসে না। মাথায় গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে। এরপর কোন সাহসে হলে তৈমুরকে খুঁজতে যাবে পিয়া! ইউনিভার্সিটির দিকে যেতেই বুকের ভেতরটা কাঁপে আজকাল। তবুও যেতে তো হবেই। তৈমুরের সঙ্গে দেখা না করে পিয়া থাকবে কেমন করে!
কিন্তু তৈমুর, তৈমুর তুমি আমাকে অত কষ্ট দিচ্ছ কেন? আমি আর কতকাল অপেক্ষা করব?
ইউনিভার্সিটি শেষ হওয়ার পর থেকেই পিয়ার বিয়ের চেষ্টা হচ্ছে। বাড়ি থেকে ওঠে পড়ে লেগেছে সবাই। পিয়ার জন্য টিয়ার বিয়েটা আটকে আছে। টিয়া বাচ্চা মেয়ে। ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্রী। হলে কি হবে, টিয়ার শরীর খুব বাড়ন্ত। এই বয়সেই মহিলাদের মতো আচার-আচরণ। পড়াশুনোয়ও খুব খারাপ টিয়া। সারাজীবন পড়াশুনো করেও ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত যেতে পারবে না। মা বাবা এখনি টিয়ার বিয়ের কথা ভাবছে। পিয়ার হয়ে গেলেই টিয়া। দুটো মাত্র মেয়ে। তাড়াতাড়ি বিদেয় হলেই সংসারের ভার কমে।
পিয়া মাকে বলেছিল, আমার জন্য টিয়া আটকে থাকবে কেন? ওর বিয়ে দিয়ে দাও।
কথাটা বাবার কানে যেতেই ভীষণ হয়ে গেল। বাবার মান-সম্মানের ব্যাপার। বড় মেয়ে রেখে ছোটটির বিয়ে হলে লোকে দুর্নাম গাইবে। বড়টির হল না কেন, ইউনিভার্সিটি পড়া মেয়ে, চরিত্রের প্রশ্ন। শুনে পিয়া মনে মনে হেসেছে। মধ্যবিত্তের অহংকার। এইট্টুকুই সম্বল এদের।
তবুও তৈমুরের কথা মা বাবাকে বলা হয়নি। বলতে সাহস পায়নি পিয়া।
ছেলে এখনো এম. এ. পাশ করেনি। তার ওপর রাজনীতি করে। রাজনীতি করা ছেলেরা সংসারী হয় না। মেয়েটার জীবন বরবাদ হয়ে যাবে। বাবা কিছুতেই রাজি হবেন না। প্রয়োজনে অমন মেয়ের মুখ দেখবেন না সারাজীবন। সেই ভয়ে পিয়ার কিছু বলা হয়নি। বাবা একবার মুখ থেকে না বের করলে মরে গেলেও হা করবেন না। অসম্ভব জেদি মানুষ। কেরানিগিরি করে মেয়েকে ইউনিভার্সিটি পড়িয়েছেন সেই বাবাকে কেমন করে কষ্ট দেবে পিয়া। কেমন করে! কেমন করে!
তৈমুরের কথা কেবল টিয়া জানে। রাতেরবেলা এক চৌকিতে ঘুমোয় দুবোন। একরাতে কী জানি কী মনে করে টিয়াকে বলে ফেলেছিল। শুনে টিয়া সরলভাবে বলল, তোরা পালিয়ে বিয়ে কর। তারপর দেখা যাবে।
শুনে ভয়ে কুঁকড়ে গেছে পিয়া। মাগো আমার অত সাহস নাই। ভাবলেই হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়।
এতো দুর্বল মন তো পিরিত কর কেন? টিয়া রেগে গেছে।
কিন্তু পিয়া কী করে? তৈমুরকে ছাড়া তার কোনও উপায় নেই। তৈমুরের গায়ে সারাক্ষণ ঘামের কটু গন্ধ। চেহারায় একধরনের রুক্ষ্মতা। কথায় ড্যাম কেয়ার ভাব। এর সবই পিয়ার খুব প্রিয়। পিয়ার কাছে পুরুষ মানুষ মানেই তৈমুর।
অথচ বাবা যেখানে বিয়ের চেষ্টা করছে ছেলেপক্ষও খুব এগিয়েছে। এখনো কিছু না করলে হয়ে যাবে। ছেলে লিবিয়া থাকে। ইঞ্জিনিয়ার। পাকা কথা হয়ে গেলে মাসখানেকের ছুটি নিয়ে দেশে আসবে তারপর বউ নিয়ে আবার লিবিয়া।
বিদেশে থাকা লোকজন কেমন হয়?
কদিন ধরে এই কথাটা ভাবছে পিয়া। ছিমছাম পরিপাটি। গায়ে পাউডার না মেখে ঘুমোতে পারে না। পুরুষমানুষের গায়ে পাউডারের গন্ধ! ইস কী বিচ্ছিরি!
কাল সারারাত এই সব ভেবেছে পিয়া। তারপর সকালবেলা ওঠে ঠিক করেছে যেমন করেই হোক আজ তৈমুরের সঙ্গে দেখা করবে। তৈমুরকে সব খুলে বলবে। তৈমুর বললে পালিয়ে বিয়েটা করে ফেলবে। নয় তো আর কোনও উপায় নেই। পিয়া চলল।
পিয়া বাড়ি থেকে বেরিয়েছে সাড়ে দশটার দিকে। গলির মাথা পেরিয়ে বড় রাস্তা। তারপর বাসস্ট্যান্ড। ফার্মগেট থেকে ইউনিভার্সিটি রিকশায় যাওয়া অসম্ভব। ভাড়া নেবে আড়াই টাকা। ব্যাগে একটা দশ টাকার নোট আছে। তবুও বাসস্ট্যান্ডের দিকে যায় পিয়া।
কিন্তু বাসে কী ভিড়! মনে হয় সাড়ে সাত কোটি বাঙালী সবাই একটা বাসে চড়ে বসে আছে। দ্রুত কোন একটা গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া দরকার তাদের। একটা পিঁপড়ে ঢোকারও জায়গা নেই। মন খারাপ করে পিয়া একটা রিকশা নেয়।
কাউরান বাজার তেরাস্তার মোড়ে একটা ফাঁইভস্টার হোটেল হচ্ছে। তার ডান পাশে নতুন রাস্তা। রাস্তার পাশে জলাভূমি। জলের ওপর টং বেঁধে দুঃখী মানুষেরা থাকে। অথচ সেখানেই বিরাট টিনের সাইনবোর্ড। পরিবার পরিকল্পনার বিজ্ঞাপন। ছেলে হোক মেয়ে হোক দুটি সন্তানই যথেষ্ট। কিন্তু বাংলাদেশে প্রতিদিন দশ হাজার শিশু জন্ম নিচ্ছে। এত ছোট্ট দেশে এত লোক থাকবে কোথায়! দু পাঁচ বছর পর বঙ্গোপসাগরের ওপরও বুঝি তৈরি হবে মানুষের ঘরবাড়ি।