এ কথায় কেন যে তৈমুরের বুকের ভেতরটা একটু দুলে ওঠেছে! চোখ ছলছল করে ওঠেছে। রাজনীতি করে কী হবে! লক্ষ্যে কি কখনও পৌঁছানো যাবে!
বাংলাদেশ। জঘন্য। রাজনীতি মানে হাউকাউ। কয়েকদিন গলাবাজি করে একেক শালা ক্ষমতায় যাবে, তারপর আর দেশ কী, জনগণ কী! নিজের পেট মোটা করবে শালারা, গাল বানাবে সেদ্ধ গোল আলুর মতো। মার্সিডিস চড়ে যাবে বক্তৃতা দিতে। দেশ যা আছে তাই থাকবে। গুষ্টি মারি শালা রাজনীতির। মা, প্রেমিকাদের চোখের ঘুম কেড়ে কী হবে এসব করে! মন্টুদের বাসা থেকে বেরিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তৈমুর ডিসিশান নিয়েছে লাইনটা ছেড়ে দেবে। হল ছেড়ে ভাইয়ের বাসায় গিয়ে ওঠবে। এখনও মাস তিনেক সময় আছে। তিন মাস এনাফ টাইম। পড়াশুনা করলে সেকেন্ড ক্লাস সিওর। তারপর চাকরি। পিয়া আর কতকাল অপেক্ষা করবে!
রাতটা এসব ভেবে কেটেছে তৈমুরের। ভোরবেলা ঘুম ভেঙেছে পাঁচটায়। তারপরই মনে। পড়েছে মন্টুর কথা। মন্টুকে খুঁজতে বেরিয়েছে। নেই, মন্টু কোথাও নেই।
মন্টু যে কোথায় গেল! কথাটা ভাবতেই মন্টুর মায়ের কথা মনে পড়ে। মন্টুর মা একশো টাকা দিয়েছেন মন্টুর জন্যে। টাকাটা বুক পকেটে আছে। সারা সকাল পায়ে হেঁটে মন্টুকে খুঁজেছে তৈমুর। টাকাটা ভাঙেনি। মন্টু কি এই নিয়ে পরে হাসাহাসি করবে! তুই একটা ছাগল। শালা। এসব বলবে!
তৈমুরের দীর্ঘশ্বাস পড়ে।
সারোয়ার বলল, পিয়ার খবর কীরে? বহুদিন দেখি না।
টেবিলের ওপর থেকে স্টারের প্যাকেটটা নেয় তৈমুর। তারপর সিগারেট ধরিয়ে টানে। আমার সঙ্গেও দেখা হয় না।
মেয়েটাকে তুই বড় কষ্ট দিচ্ছিস।
তৈমুরের তখন চোখ পড়ে ডান হাতের দুটো আঙ্গুলের দিকে। সিগারেটের তাপে আঙুলের মাথায় হলদে দাগ পড়ে গেছে। দেখে তার মনে হয়, পিয়াকে কি আমি খুব পোড়াই! পিয়ার বুকের ভেতরও কি এরকম দাগ পড়েছে! তৈমুর তারপর একটু উদাস হয়ে যায়। আমি এসব ছেড়ে দেব। কালই বড় ভাইয়ের বাসায় গিয়ে উঠব। পরীক্ষাটা দিয়ে ফেলব। পিয়াকে আর কষ্ট দেয়া ঠিক হবে না।
রতন বলল, পারবি না। এসবের একটা নেশা আছে। নেশায় আমাদের পেয়ে বসেছে। এই নেশা কাটাতে পারবি না।
আমাকে পারতেই হবে।
বাবুল বলল, এই ট্র্যাপ থেকে বেরুবার কোনও উপায় নেই দোস্ত। দল ছেড়ে দিলে দলের ছেলেরাই তোর লাশ ফেলে দেবে।
এখনই কি সুখে আছি! ছায়ার মতো পেছনে লেগে আছে শালারা। কখন মেরে দেবে টেরও পাব না।
এ কথায় সারোয়ার একটু রেগে ওঠে। মেয়েমানুষের মতো প্যানপ্যানাস না তো! আমাদের মারলে কি আমরা হাত খুলে বসে থাকব! আমাদের একটা ছেলের গায়ে হাত তুলুক না! পুরো দেশ জ্বালিয়ে দেব শালা। সেদিনের সব পুঁচকে পোলাপান, শালাদের বহর দ্যাখো না! যন্ত্রের জোর। যন্ত্র পাছা দিয়ে ভরে দেব।
রতন বলল, জোর তো ওখানেই। ওদের ব্যাক করছে সরকারি দল। দরকার হলে পুলিশ ওদের সঙ্গে থাকবে। কী করবি?
শোন এ সব বেশি দিনে থাকে না। সারোয়ার একটা সিগারেট ধরায়। একাত্তরে দেখলি না পাকিস্তানি বাবাদের শক্তিশালী মনে করে কুত্তার বাচ্চারা কেমন রাজাকার হয়েছিল! আলবদর আলসামস হয়েছিল। তার রেজাল্টটা কী হল? স্বাধীনতার পর শালাদের পাছায় বাঁশ দিয়ে চৌরাস্তা মোড়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছি না? এই শালাদের অবস্থাও তাই। হবে। দেখিস, দিন আসবে।
কটা রাজাকার মারতে পেরেছ! বেশির ভাগ রাজাকারই তো দেখি এখন চমৎকার হালে আছে।
ওই তো! ভুলটাই তো ওখানে। শালাদের ক্ষমা করা হয়েছিল। এবার আর ক্ষমা নেই। শালাদের বংশ আর রাখব না।
তৈমুর কোনও কথা বলছিল না। সিগারেট টানতে টানতে উদাস হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ জামতলার দিকে চোখ যেতেই চমকে ওঠে সে। চারজন দাঁড়িয়ে আছে। জিনসের স্কিন টাইট প্যান্ট পরা, গায়ে চক্রাবক্রা শার্ট। মাথায় লম্বাচুল প্রত্যেকের। আর চোখ কী লাল একেকটার! তৈমুর এদের চেনে। জুনিয়ার পোলাপান। ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েই নেমে গেছে। যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াচ্ছে হলে, ইউনিভার্সিটিতে। প্রত্যেকের কাছেই অস্ত্র আছে। ওরাই তো, ওরাই তো বেশ কিছুদিন ধরে চোখ রাখছে তৈমুরদের ওপর!
তৈমুর দেখে রাস্তার ওপর হোন্ডা দুটোও দাঁড়িয়ে। শালারা এল কখন! হোন্ডায় কি শব্দ হয়নি! তৈমুর এত আনমনা হয়ে কী ভাবছিল! হোন্ডার শব্দ পায়নি কেন?
ততক্ষণে সারোয়াররা সব চুপচাপ হয়ে গেছে। সবার চোখ এখন জামতলায়। তক্ষুনি, ঠিক তক্ষুনি তৈমুরের বুকের ভেতরটা কি একটু কেঁপে ওঠে! মন্টুকে কি তাহলে এরাই কোথাও আটকে রেখেছে, না কি?
তৈমুররা সবাই তাকিয়েছে, ওরা টের পায়। তারপর কী কথায় নিজেরা খুব হাসাহাসি করে। একজন লাল শার্টের পকেট থেকে ট্রিপল ফাঁইভের প্যাকেট বের করে। তারপর সিগারেট ধরিয়ে হোন্ডায় গিয়ে চড়ে। এক হোন্ডায় দুজন করে। তারপর তীব্র শব্দ, সাইলেন্সার পাইপে সাদা ধোয়া। হোন্ডা চলে যায়। সেই দিকে তাকিয়ে তৈমুরের মন কু ডাক ডাকে। মন্টু, তোর পর কে?
মন বলে, তুমি! তুমি!
.
বহুকাল পর বাড়ি থেকে বেরুল পিয়া। মাসখানেক হবে। আজকাল বাড়ি থেকে বেরুতে ভাল্লাগে না। কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে। তৈমুরের সঙ্গে দেখা হয় না অনেকদিন। ইউনিভার্সিটির দিকে না গেলে তৈমুরকে পাওয়া যায় না। হলে কখন ফেরে কখন বেরোয় তার ঠিক নেই। আগে দু একবার হলে গিয়ে তৈমুরের সঙ্গে দেখা করেছে। হলে যাওয়া হয় না বহুদিন। তৈমুরকে একা পাওয়া হয় না বহুদিন। পুরো একটা বছর পেরিয়ে গেল ইউনির্ভাসিটি ছেড়েছে পিয়া। এই এক বছর তৈমুরকে আর বুকের কাছে পায়নি। বুকটা মাঝে মধ্যে কেমন করে পিয়ার।