দোকানের বাচ্চা ছেলেটা খালি কাপ তুলে নিতে এসেছিল। রতন বলল, একটা নাস্তা দে।
নাস্তার মানে ছেলেটা জানে। দু টুকরো পাউরুটি, একটা কলা আর এককাপ চা।
তৈমুর রতনের দিকে তাকিয়ে একটু হাসে। জ্যাবে নাল পড়েছে মনে হয়!
বাসা থেকে হাত পা ধরে পঞ্চাশটা টাকা ম্যানেজ করেছি। দিতে কি চায়! পঞ্চাশ টাকার জন্যে কত কথা!
সারোয়ার বলল, আমাদের আরো অনেককাল গার্জিয়ানদের কথা শুনতে হবে।
তৈমুর বলল, তা হবে। সংসারের জন্য কিছু করছি আমরা। পড়াশুনা শেষ হওয়ার কথা আরো তিন বছর আগে। এখন চাকরিবাকরি করার কথা। সংসার দেখার কথা। তা না, শালা মাথায় ঢুকল রাজনীতি। গলাবাজি করো আর জানটা হাতের তালুতে নিয়ে ঘোর। পুলিশ তো আছেই তার ওপর আছে সরকারি গুণ্ডা। কখন একটা লাশ রাস্তায় পড়ে যাবে। না, এই শালার জীবন আর ভাল্লাগে না।
তখুনি বাচ্চা ছেলেটা নাস্তা দিয়ে যায়। তৈমুর একবার নাস্তার প্লেটটা দেখে। তারপর উদাস হয়ে সামনের দিকে তাকায়। শরীফ মিয়ার চায়ের দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে কয়টি ছেলে চা খাচ্ছে। দোকানের ভেতর বসবার জায়গা নেই। দোকানটায় ভিড় লেগেই থাকে। ছেলেরা ভিড় দেখে জামতলার ছায়ায় দাঁড়িয়ে চা খায়, সিগারেট খায়। কেউ কেউ অলসভাবে বসে থাকে মাটি থেকে ওঠে যাওয়া বেদির মতো রাস্তায়। রুটিতে কামড় দিয়ে সেই রাস্তাটার দিকে তাকায় তৈমুর। দল বেঁধে ছেলেমেয়েরা আর্টস ফ্যাকাল্টির দিকে যাচ্ছে, পাবলিক লাইব্রেরির দিকে যাচ্ছে। এসবের ভেতরে কোথাও মন্টুর ছায়া পড়ে না।
চারদিন হয়ে গেল মন্টুর কোন খবর নেই। দলের সবচে তেজি কর্মী। কোন খোঁজখবর না দিয়ে চারদিন কোথাও কাটানো মন্টুর চরিত্রে নেই। পুলিশে খবর হয়ে যেত। তা হলে মন্টুর কোন অঘটন!
কথাটা ভাবতেই তৈমুরের গলায় শুকনো রুটি আটকে যায়। বুকটা কেঁপে ওঠে।
পানি খেয়ে তৈমুর আবার রুটিতে কামড় দেয়।
কাল বিকেলে মন্টুদের বাসায় গিয়েছিল তৈমুর। মন্টু চারদিন বাসায় ফেরে না, তাতে বাসার পরিবেশ একটুও পাল্টায়নি। বাবা নিয়মমাফিক বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে। রিটায়ার্ড মানুষ, বসে বসে সময় কাটান। মন্টুর ইমিডিয়েট ছোটভাই আর্ট কলেজে পড়ে। মহা আধুনিক পোলা। নিজের ঘরে বসে ডোনা সামার শুনছে। ও লাভ টু লাভ ইউ বেবি।
তৈমুরকে দেখে মন্টুর বাবা পুরু চশমার ভেতর থেকে তাকান। তারপর আবার মগ্ন হয়ে। যান নিজের ভাবনায়। তৈমুর হাত তুলে সালাম দিয়েছিল। শীতলভাবে সালাম নিয়েছেন। তিনি। মন্টুর কোনও বন্ধু-বান্ধবকে তিনি পছন্দ করেন না। মন্টুর মাথা বিগড়ানোর পেছনে এইসব বন্ধুর প্রধান অবদান, এটা তার বিশ্বাস। তৈমুররা কেউ কখনও মন্টুর বাসায় যায় না। মন্টু নিজেও বাসায় ফিরত না। হলে কিংবা বন্ধু-বান্ধবদের বাসায় রাত কাটাত। মাঝেমধ্যে মার সঙ্গে দেখা করত টাকা-পয়সার জন্য।
এই বাড়িতে ওই একজনই মানুষ! মন্টুর জন্য যার খানিকটা ভালোবাসা এখন রয়ে গেছে। একটা জিনিস তৈমুর কখন বুঝতে পারে না, এইরকম ফ্যামিলিতে জন্মে মন্টু কেন সব ছেড়েছুঁড়ে রাজনীতিতে নামল। ওর তো পড়াশুনা করার কথা। বড় চাকরি বাকরি করার কথা! সুন্দর বউ নিয়ে সংসার করার কথা।
বাবা ছিলেন সেক্রেটারী। ওপর লেবেলে দারুণ হাত। চাকরিবাকরি করলে বাবার জায়গায় পৌঁছুতে মন্টুর বেশিদিন লাগত না। তবুও মন্টু সব ছেড়ে কী আশায়! তৈমুর বুঝতে পারে না।
গতকাল মন্টুদের বাসায় ঢুকে কেন যেন তৈমুরের মনে হয়েছিল এই বাসায় মন্টু আর কখনও ফিরবে না। বুকের ভেতরটা একটুখানি কেঁপে ওঠেছিল। কেন যে এমন ইচ্ছে!
তৈমুরকে দেখে মন্টুর মা বেরিয়ে এসেছিলেন খানিক পর। তৈমুরকে ডেকে নিয়েছেন নিজের ঘরে। এই মহিলার কাছাকাছি এলে তৈমুর বরাবরই একটু দুর্বল হয়ে যায়। ছেলেবেলার মা মা গন্ধটা ফিরে পায়। মা মারা গেছেন সেই কবে। ছেলেবেলায়। মার কথা তৈমুরের মনে পড়ে না। কেবল এই মহিলার কাছাকাছি এলে মনে হয় মার শরীরেও এরকম গন্ধ ছিল। সব মায়ের শরীরেই বুঝি এক রকমের গন্ধ থাকে। মন্টুর মা বললেন, মন্টু বেশ কদিন বাড়ি ফেরে না। এর মধ্যে ওর বাবা একটু রাগারাগি করেছিলেন। এটা তো নতুন কিছু নয়। আগেও এমন হয়েছে। বেশ কবার। মন্টু কখনও এতটা রাগ করেনি। আমি পেছন থেকে কতবার ডাকলাম। ফিরেও তাকাল না। মন্টুর মা আঁচলে চোখ মোছেন। আগে বকাবকি করলেও মন্টু ঠিকই বাড়ি ফিরত। অনেক রাতে বাড়ি ফিরে আমাকে ডাকত। রাতেরবেলা আমি ওর খাবার ঢেকে রাখি। কাল রাতে একটুও ঘুমুতে পারিনি। বুকের ভেতরটা কেমন করছে। কেন যে বারবার মনে হয়েছে মন্টু আর ফিরবে না!
মন্টুর মা আবার চোখ মোছেন। মন্টুটা ছোটবেলা থেকেই এরকম। ও যখন বার তের বছরের তখন থেকেই ওকে নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা শুরু হয়েছে। ওর জন্যে আমি ঘুমুতে পারি না কতকাল। কতকাল যে ও আমাকে শান্তিতে ঘুমুতে দেবে না।
তৈমুর চুপচাপ বসেছিল চেয়ারে। কোনও কথা বলতে পারেনি। এসব কথার জবাব তৈমুরের জানা নেই। নিজেকে বড় অপরাধী লাগছে। মন্টু, আমরাই কি তোকে সুখী জীবন থেকে সরিয়ে নিলাম! তৈমুর যখন বেরিয়ে আসবে, মন্টুর মা আঁচলের গিট খুলে একশো টাকার একটা নোট দিয়েছেন। মন্টুর সঙ্গে দেখা হলে দিও। ওর হাতে টাকা নেই, আমি জানি। আর বলো, আমি ওর জন্যে রাত জেগে বসে থাকি। খাবার নিয়ে বসে থাকি।