লালীকে সে ছুটি দিয়েছিল। ঐ দশদিনের জন্যেই।
তারপর বাড়ি এসেছিল লালী। মায়ের কাছে এসেছিল। এসেই লুকানো টাকা-পয়সার বেশির ভাগটা তুলে দিয়েছিল মায়ের হাতে। আর কিছু রেখে দিয়েছিল নিজের ফিরে যাওয়ার খরচা হিশেবে। কিন্তু এতগুলো টাকা হাতে পেয়েও খুব একটা খুশি হয়নি মা। প্রথমেই জিজ্ঞেস করেছে এত টাকা তুই কই পাইলি?
লালী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছে, তোমার জামাইর টেকা।
জামাই এত টাকা দিল?
না, আমি সংসার খরচা থিকা বাঁচাইছি।
তয় জামাইরে লইয়া আইলি না ক্যা?
এ কথায় লালী খুব উদাস হয়ে গিয়েছিল। চোখে জল এসে গিয়েছিল তার। অন্যদিকে তাকিয়ে চোখের জলটা সামলিয়েছে সে। পুরো ব্যাপারটা মার কাছে চেপে গেছে। সত্যি। কথা বলে মার মনে দুঃখ দিতে চায়নি। কপাল, সবই কপাল লালীর। তবুও মা জানুক, স্বামীর ঘরে সুখে আছে লালী। লালীর দুঃখী জীবনের কথা নাই বা জানল সে।
লালীর মা আর কোনও কথা বলেনি। মিথ্যে সুখে বিভোর হয়ে মেয়ের জন্যে এটাওটা তৈরি করেছে। দশদিন ভিক্ষা করতে বেরোয়নি।
হায়রে মানুষের সুখ।
কাল সকালেই লালী তার মাকে জানিয়েছিল, মাগো আমি কইলাম কাইল বিয়ানে যামু গা।
শুনে বুড়ি হা হা করে ওঠেছিল। বিয়ার পর পয়লা বাপের বাড়ি আইলি আর দুইডা দিন থাইক্কা যা মা।
লালীরও খুব থাকতে ইচ্ছে করছিল। চিরকালের জন্যে থেকে যেতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু থেকে গেলেই অনাহার। যখন তখন গ্রামের ফক্কর লোকেরা এসে ঘরের ভেতর নয়ত ঝোপজঙ্গলে কাপড় খুলবে লালীর। বিনি মাগনা কাজ সেরে যাবে। লালীর তাতে লাভ কী। পেটের আহার তো আর কেউ দেবে না!
লালী বলেছিল, আর দুদিন থাকলে তুমার জামাই রাগ করব। আসলে লালীর মনে ছিল। ভয়। দেরি করে গেলে বুড়ি যদি তাকে আর পাড়ায় ঢুকতে না দেয়। তাহলে সব যাবে লালীর। লালীর কথা শুনে তার মা বলেছিল, কাম নাই থাকনের। যা গা। আবার যহন আবি জামাই লইয়াবি। দুমাস থাইক্কা যাবি। তারপরই বুড়ি বসে গিয়েছিল বোড়া পিঠা ভাজতে। ভাত-তরকারি রান্নার ফাঁকে ফাঁকে সারাদিন পিঠা ভেজেছে বুড়ি। রাতের বেলা সেই পিঠার কিছুটা লালীকে খেতে দিয়ে বাকিগুলো পুরনো একটা ন্যাকড়ায় বেঁধে লালীর টিনের বাক্সে ভরে দিয়েছে। জামাইরে বেবাকটি পিডা খাওয়াবি লালী। কবি তুমার হরি দিছে। খাও, বেবাকটি খাওন লাগব।
শুনে লালীর চোখে জল এসে গিয়েছিল। ইচ্ছে করেছিল মার গলা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদে লালী। কাঁদতে কাঁদতে সব কথা খুলে বলে মাকে।
কিন্তু কী লাভ। যে জীবন স্বামী-সংসার নিয়ে সুখী মেয়েমানুষের জীবন, লালী কি সেই জীবন কখনও ফিরে পাবে। ওই যে দেখুন, লালী তার নিয়তির কাছে ফিরে যাচ্ছে।
লঞ্চঘাটে এসে দেখা গেল টাউনে যাওয়ার লঞ্চটি ছাড়ার উপক্রম করছে। যাত্রীরা বেশির ভাগ ওঠে পড়েছে। দুচারজন লঞ্চের সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে প্রিয়জনদের সঙ্গে কথা বলছে। লঞ্চওয়ালারা তাড়া দিলেই লাফিয়ে ওঠবে।
মার হাত থেকে বাক্সটা নিয়ে লালী বলল, তুমি যাওগা মা, অহনঐ লঞ্চ ছাইড়া দিব।
মা বলল, লঞ্চ ছাড়লেই যামুনে। তুই কইলাম বেবাকটি পিডা জামাইরে খাওয়াইচ।
লালী অন্যদিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, আমার তো জামাইর আকাল নাই মা। আইজ রাইত্রে যেই যেই জামাই আইব আমার ঘরে তাগো বেবাকতেরেঐ খাওয়ামু।
মা বলল, আবার যহন আবি জামাই লইয়াবি। একলা কইলাম আহিচ না। আমি কবে মইরা যামু ঠিক নাই। তগ দুজনরে একলগে দেখলে মোনে শান্তি পামু।
এ কথায় বুকের ভেতরটা তোলপাড় করে ওঠে লালীর। নিজেকে আর সামলাতে পারে না সে। বাক্সটা হাত থেকে ফেলে দুহাতে মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। মা দুহাতে লালীর মাথাটা বুকে চেপে ধরে। সেও কাঁদে। এই কান্নায় জগৎ সংসার মুহূর্তের জন্য থেমে থাকে।
আপনারা কি জানেন, ওটুকু কান্নাই লালীদের ক্ষণকালের মুক্তি!
লাশ পড়ছে
মন্টুর খবর পেলি?
ঘামে তৈমুরের বুকের কাছটা ভেজা। মুখে ক্লান্তির ছাপ।
সারোয়াররা চারজন বসেছিল একটা টেবিলে। টেবিলের দুপাশে দুটো বেঞ্চ পাতা। একবার চা হয়ে গেছে। টেবিলের ওপর খালি কাপ পড়ে আছে। একটা কাপে সারোয়ার সিগারেটের ছাই ফেলছে। একটা স্টারের প্যাকেট টেবিলের ওপর।
তৈমুর চারদিক তাকিয়ে দোকানের ভেতরটা দেখে। এটা ওর অভ্যেস। কোথাও ঢুকে প্রথমেই পরিবেশটা দেখে নেয়। কে কে আছে এক পলকে তৈমুরের দেখা হয়ে যায়।
নেই, ওরা কেউ নেই। কটি বাংলার ছাত্র বসে সাহিত্যফাঁহিত্য নিয়ে মুগ্ধ হয়ে কথা বলছে।
ওরা আছে ভালো। বাপের পয়সায় খাচ্ছে, হলে ঘুমুচ্ছে আর মুখে পাউডার মেখে বাংলা পড়ে যাচ্ছে।
তৈমুর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর সারোয়ারকে একটু ঠেলে দেয়। সর। তারপর বসে পড়ে।
সারোয়ার সিগারেটে শেষ টান দিয়ে খালি কাপে সিগারেটটা ফেলে দেয়। তখন বাবুল আবার জিজ্ঞেস করে, মন্টুর খবর পেলি?
না।
শুনে সবাই চুপচাপ। কেবল সারোয়ার একপলক তৈমুরকে দেখে।
নাস্তা খেয়েছিস?
না।
সকাল থেকে করেছিস কী? এগারটা বাজে।
তৈমুর বিরক্ত হয়ে বলল, কী করব, ভোরবেলা ওঠে বেরিয়েছি। মন্টুর যত চেনা জায়গা আছে সব জায়গায় গেলাম। শালা আজ গরমও পড়েছে।
তৈমুর পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মোছে। পায়ে হেঁটে কত ঘোরা যায়। পকেটে একটা পয়সা নেই।