বেড়ান অইয়া গেলনি মাইয়ার?
হ। দশদিন বেড়াইছে।
লালীর তখন বুকের ভেতরটা তোলপাড় করে ওঠেছে। জামাইর কাছে যাচ্ছে সে। নিজের সংসারে যাচ্ছে। এই ভেবে মুখে, যেন নিজেকেই বিদ্রূপ করছে এমন একটা হাসি ফুটে ওঠেছে লালীর। মনে মনে নিজের সঙ্গে কথা বলেছে লালী। আমার জামাই কেডা? হেই মানুষটা! কয় কী! আমার তো দিহি রোজ রোজ, বেলায় পাড়াডা। মায়নি এই হগল জানে!
না মাকে কিছুই জানায়নি লালী। শেষ বয়সে মানুষটার মনে দুঃখ বেলায় নতুন জামাই। দিনের মইদ্যে দশ বিশটা। সংসার তো হেই দিয়ে! কী লাভ! জামাইর সংসারে মেয়ে তার সুখে আছে এটুকু ভেবে নিজেও সুখে থাক লালীর মা। লালীর সব কথা শুনলে মেয়েকে নিয়ে যাবতীয় স্বপ্ন ভেঙে যাবে বুড়ির। লালীকে সে আর টাউনে যেতে দেবে না। টাউনে না গেলে শরীরের জেল্লা থাকবে না। আবার অনাহার। মা ভিক্ষা করে দুজন মানুষের ভাত জোটাতে পারবে না। তার এই রকম খোলামেলা বাড়িতে, ভাঙা কুঁড়েঘরে একলা যুবতী মেয়ে। গ্রামের ফক্কা লোকেরা উৎপাত করবে। রাতবিরাত বাড়ি এসে হামলা করবে। টাউনে যাওয়ার আগে দুবার এমন হয়েছিল। একদিন দুপুরবেলা, মা গেছে ভিক্ষা করতে, লালী একা ঘরে। চারজন লোক এসে ঘরের ভেতরই লালীকে ধর্ষণ করে গেল। একজন হাত মুখ চেপে রাখল, একজন কাজ সারল। আর দুজন থাকল। পাহারায়। এইভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চারজন সারা দুপুর। লালী অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। সন্ধ্যেবেলা মা ফিরে আসার আগেই জ্ঞান ফিরেছিল তার। বসে বসে অনেকক্ষণ ধরে কেঁদেছিল সে। তবুও মাকে বলেনি।
তারপর টাউনে যাওয়ার কয়েকদিন আগে আবার। সেদিন দুপুরের মুখে মুখে। সেই চারজনেই। তবে ঘরের ভেতর নয় ঝোপঝাড়ের আড়ালে তুলে নিয়েছিল লালীকে।
তবুও এই ব্যাপারেও হয়তো আপত্তি করত না লালী। কাজ সেরে যদি কিছু পয়সা দিত তারা। যদি দুবেলা পেটপুরে ভাত পেত। যেটা এখন পায় লালী। পয়সা এবং ভাত। থাকার ব্যবস্থাও খারাপ নয়। এ সবই লালী পাচ্ছে শরীর দিয়ে।
কিন্তু লালী কি জানত এরকম একটা জীবন হবে তার।
লোকটা বিয়ের প্রস্তাব দিতেই লালী ভুলে গিয়েছিলে দুদুবার ধর্ষিতা হয়েছে সে। অনাহারে দিন যায়। স্বামীসংসার পেয়ে, ভাতকাপড় পেয়ে সুখি মেয়েমানুষের জীবন হবে তারও। লোকটার ঘরবাড়ি কোথায়, সংসারে কে আছে, না আছে না জেনেই একরাতে নিজেদের কুঁড়েঘরে বিয়ে হয়েছিল তার। শুধু ঐ একটা রাতই লোকটার সঙ্গে ছিল সে। বুড়ি মা রাত কাটিয়েছিল বাইরে। পরদিন সকালে ওঠেই লোকটার হাত ধরে টাউনে চলে গিয়েছিল সে। কিন্তু লোকটার সঙ্গে আর একটি রাতও থাকা হয়নি তার। জীবনে শুধু ঐ একটি রাতই কেটেছে তার স্বামীর সঙ্গে।
টাউনে নিয়ে সেই লোকটা লালীকে সোজা তুলেছিল পাড়ায়। তারপর এক বুড়ির হাতে লালীকে বুঝিয়ে দিয়ে কোথায় যে চলে গেল, লালীর সঙ্গে ছমাসে লোকটার আর কখন দেখা হয়নি।
পাড়ায় লালীর মতো দুচারশো মেয়ে। তাদের ভাতকাপড়, থাকা এবং পয়সার উৎস বুঝতে দুচারটা দিন লেগেছিল লালীর। সেই কটা দিন লালী খুব কেঁদেছে। বুড়ির কাছে স্বামীর কথা জানতে চেয়েছে। কোন ফল হয়নি।
তারপর থেকে দিনে দশ বিশটা করে স্বামী লালীর। বাপের বয়সী, ছোট ভাই, বড় ভাইর বয়সী, দাদা নানার বয়সী। দিনে দিনে দিন যেতে লাগল লালীর। তিনবেলা ভরপেট খাওয়া, অর্ধেক পয়সা বুড়িকে দিয়ে, ঘর ভাড়া দিয়েও লালীর হাতে পয়সা জমতে লাগল প্রতিদিন। মাস ঘুরতে না ঘুরতে শরীর বদলে গেল লালীর। চেহারা বদলে গেল। নতুন শাড়ি সায়াব্লাউজ। ফেরিঅলার কাছ থেকে কেনা ইমিটেশানের চুড়ি, গলার মালা, কানের দুল, নাকফুল। টিনের বাক্সটা মাসখানেকের মাথায়ই কিনে নিয়েছিল লালী। পয়সাকড়ি সেই বাক্সে জমা হতে লাগল। কারণ স্বামীর কথা লীলা ভুলতে পেরেছিল, বুড়ি মাটার কথা ভুলতে পারেনি। ভিক্ষে করে খেয়ে, না খেয়ে তার জীবন চলছে। কখনও মার কাছে যেতে পারলে জমানো টাকা-পয়সা তার হাতে দিয়ে আসবে লালী। তাতে মা মেয়ে-মানুষটার বেশ কিছুদিন সুখে কাটবে। কিন্তু প্রতিদিন দশ বিশটা স্বামী সামলাতে মাস ছয়েকের মাথায় ক্লান্ত হয়ে পড়ল লালী। চোখের কোলে গাঢ় হয়ে কালি পড়ল তার। শরীর আর চলতে চায় না। বাক্সে কিছু টাকা-পয়সাও জমা হয়েছে। একবার গ্রামে যেতে পারলে টাকা-পয়সাটা মার হাতে দিয়ে আসা যাবে, কয়েকটা দিন জিরানো যাবে।
লালী একদিন বুড়িকে বলল, খালা আমি ইট্টু বাইত যাইতে চাই। শুনে বুড়ি হা হা করে ওঠল, কচ কী মাগি, আ?
হ। দশদিনের বেশি থাকুম না।
পাড়ার মেয়েরা অনেকেই মাঝে মাঝে বাড়ি যায়। আট দশদিন থেকে ফিরে আসে। কিন্তু লালী নতুন মেয়ে, একবার বাড়ি গিয়ে যদি আর ফিরে না আসে। যে দামে লালীকে কিনেছে বুড়ি সেই টাকাটাই তো ওঠেনি এখনও। তাহলে?
অনেকক্ষণ লালীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল বুড়ি। বুড়ির তাকানো দেখে লালী বুঝতে পেরেছিল বুড়ি তাকে সন্দেহ করছে। বুঝে ম্লান হাসছিল লালী। তুমি ঘাবড়াইয়ো না খালা। আমি দশদিন থাকইক্কাই আইয়া পড়ুম।
তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে। এহেনে না আইয়া যামু কই। এই কাম না করলে খামু কী!
লালীর মতো বহু মেয়ে চরিয়ে খেয়েছে বুড়ি। লালীর কথায় বুঝতে পেরেছিল এখানে না এসে আর উপায় নেই লালীর। কপালটা এই পাড়ায় বাঁধা হয়ে গেছে ছেমড়ির।