তারা আর কতকাল অপেক্ষায় থাকবে!
লালীদের কথা
ও লালীর মা, মাইয়া লইয়া কই যাও?
লালী হাঁটছিল আগে আগে। লালীর পরনে কটকটে গোলাপি রঙের নাইলনের শাড়ি। বগলের লোম দেখা যায় এমন হাতকাটা ব্লাউজ। ব্লাউজের রঙটাও গোলাপি। তবে কাপড়টা সুতি বলে অল্প ব্যবহারেই ব্লাউজের রঙটা ক্ষয়ে গেছে। শাড়ির জেল্লাটা এখন রয়ে গেছে। জিনিসটা নাইলনের তৈরি বলে। তার ওপর সোনালি জরি লাগানো পাড়। ফলে শাড়িটা যত উজ্জ্বল দেখায় ব্লাউজটা দেখায় তত মলিন।
লালীর পায়ে ছিল উঁচু হিলের তীব্র লাল স্যান্ডেল। গ্রামের দাদরা-খাদরা পথে লালী তাই সহজ ভঙ্গিতে হাঁটতে পারছিল না। তার চলা ছিল গাভীন গাইগরুর মতো ধীর। মন্থর। লালীর দুহাতে ছিলো অনেকগুলো করে ইমিটেশনের ঝলমলে চুড়ি। গলায় ছিল ইমিটেশনের চেন। সকালবেলা পুকুরে ডুব দিয়ে মাথায় চপচপা তেল দিয়েছিল লালী। তারপর পিঠের মাঝমাঝি অব্দি লম্বা চুলের মাঝ মধ্যিখানে অর্থাৎ ঘাড়ের ওপর চুলে পরেছে রাবার ব্যান্ড লাগানো প্লাস্টিকের গোলাপি একটা ফুল। কপালে দুপাশের চুলে ছিল তার দুটো করে চওড়া সোনালি ক্লিপ।
লালীর গায়ের রং আগে বেশ কালো ছিল। রোগা টিংটিংয়ে ছিল লালী। মাস ছয়েক টাউনে আছে বলে গায়ের রং খানিকটা ফর্সা হয়েছে তার। শরীরে মাংস লেগেছে। ব্লাউজের বাইরে লালীর বাহু দুটো কলা চারার মতো সতেজ। আগের শুকনো চিটচিটে বুকও আর নেই লালীর। তার বুক এখন চালকুমড়োর মতো। শাড়ি-ব্লাউজের আড়ালেও তা বেশ স্পষ্ট। লালীর নিতম্ব ছ মাস আগে কারো চোখে পড়ত না, এখন, ঐ দেখা যায়, ধীরমন্থর হাঁটার তালেও ডানবাঁ ডানবাঁ করছে।
মুখে স্নোপাউডার মেখেছে লালী। ঠোঁটে গাঢ় করে লাগিয়েছে লিপিস্টিক। নাকে সস্তা পাথরের ফুল লালীর। কানে ইমিটেশনের রিং। চোখে গাঢ় করে টানা কাজল। তবুও চোখের কোলের কালি ঢাকা পড়েনি।
দশদিন আগে লালী যেদিন গ্রামে এল সেদিনও লালীর পরনে ছিল আজকের মতো শাড়ি ব্লাউজ। শুধু চুলগুলো ছিল উস্কখুষ্ক। আর হাতে ছিল সবুজ রঙের, তার ওপর লাল, নীল ফুল আঁকা টিনের ছোট্ট বাক্স। যেটা আজ হাতে নিয়েছে লালীর মা। সেই শীর্ণকায় বৃদ্ধা, যার মাথার চুল ময়লা নোংরা পাটের আঁশের মতো। ভাঙাচোরা ফোকলা মুখ। খোলা চোখে তার ঝাপসা দৃষ্টি। পরনে তার মেটে রঙের কাপড়। কতকাল দেয়া হয়নি কে জানে। লালীর টিনের বাক্সটা হাতে নিয়ে, ট্যাংরা মাছের মতো একদিকে বাঁকা হয়ে লালীর পেছন পেছন হাঁটছিল সে।
বাক্সটা মার হাতে দিতে চায়নি লালী। বুড়ি জোর করে নিয়েছে। এতকাল পরে এসে, মাত্র দশদিন থেকে মেয়ে আজ চলে যাচ্ছে, বুড়ি কোন প্রাণে মেয়েকে বাক্স হাতে নিতে দেবে।
এই তো দশদিন আগে লালী যেদিন গ্রামে এল সেদিন তার চোখের কোলের কালিটা ছিল আরও গাঢ়। চেহারায় ছিল জগৎসংসারের যাবতীয় ক্লান্তি। মার কাছে এসে এই কটা দিন লালী কেবল ঘুমিয়েছে। ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠেছে বেলা অনেকটা ওঠে যাওয়ার পর। তারপর প্রাতঃকালীন কাজকর্ম সেরে, মুখে কিছু দিয়ে আবার ঢুকে গেছে তাদের ভাঙাচোরা কুঁড়েঘরে। হোগলার বিছানায় শুয়ে আবার ঘুম। দুপুরে ঢলে যাওয়ার পর ভাত বেঁধে, গুড়াগাড়া মাছের ঝোল বেঁধে মা তাকে ডেকে তুলেছে। ও লালী, ওট মা। ভাত অইয়া গ্যাছে। ঘুম ভেঙে গামছাকাপড় হাতে লালী চলে গেছে খালপাড়। তারপর খালে ডুব দিয়ে এসে চুপচাপ ভাত খেয়েছে। তখন ঘুমে-ক্লান্তিতে তার চোখ টানছে।
মেয়েকে খেতে দিয়ে, দুটো একটা কথা জিজ্ঞেস করেছে লালীর মা বুড়ি। জামাইয়ের কথা, লালীর সংসারের কথা। লালীর সঙ্গে তার জামাই এল না কেন। বিয়ের পর বাপের বাড়ি এল মেয়ে, জামাই ছাড়া এল কেন? না হয় লালীর মা বুড়ির কোন ক্ষমতা নেই মেয়ে জামাইকে একবেলা খাওয়াবার। না হয় নিজেদের টাকা-পয়সা ব্যয় করেই খেত তারা, তবুও দুজন একত্রে এলো তাদের দেখে সুখে বুক ভরে যেত বুড়ির।
লালী এসব কথা শুনে কোন কথা বলত না, বুক কাঁপিয়ে কেবল দীর্ঘশ্বাস পড়ত তার। তারপর হোগলার বিছানায় শুয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ত সে। লালীর মা ভাবত, টাউনে স্বামীর সংসার করতে করতে জানটা শেষ হয়ে গেছে মেয়ের। কদিন জিরাক মেয়েটা। আহা বাছা! কিন্তু দশটা দিন এইভাবে ঘুমিয়ে কাটিয়েও চোখের কোলের কালিটা একেবারে মুছে যায়নি লালীর। তীব্রতাটা একটু কমেছে এই যা। তীক্ষ্ণ চোখে তাকালে গাঢ় কাজল টানা চোখেও ক্লান্তির কালিমা দেখা যায় লালীর।
লালীর মা চোখে ভালো দেখতে পায় না। লালীর স্বাস্থ্য খুব ভালো হয়েছে শুধু এটুকুই সে দেখতে পেয়েছে। তার চোখ দিয়ে নয়, দেখেছে লালী যেই মুহূর্তে বাড়ি এল, তাকে জড়িয়ে ধরে হাতাপিতা করে। ওটুকু দেখেই ফোকলা মুখে হাসি ফুটেছিল তার। বুড়ি। ভেবেছে, জামাই খুব সুখে রেখেছে তার মেয়েকে। হল্লাচিল্লা করে পড়শিদের ডেকে এনেছিল সে। তারাও আপাতদৃষ্টিতে দেখেছিল লালীকে। লালীর স্বাস্থ্য এবং শাড়ির জেল্লা দেখে তারা কেউ খুশি হয়েছে, কেউ হয়েছে ঈর্ষান্বিত।
কিন্তু লালীর গল্পটা এরকম নয়।
আজ সকালবেলায় বাড়ি থেকে বেরুতেই পড়শীরা কেউ কেউ জিজ্ঞেস করেছে, ও লালীর মা মাইয়া লইয়া কই যাও?
সকালবেলার রোদে লালী তখন জ্বলছিল। লালীর কাপড়চোপড়ে ভরা বাক্সটা হাতে নিয়ে, কষ্টে কষ্টে লালীর পেছনে পেছনে হাঁটছিল লালীর মা। পেছন থেকে মেয়েকে দেখে গর্বে তার বুক ভরে গেছে। আহা, টাউনে জামাইর কাছে মাইয়া আমার সুখে আছে, পড়শীদের উদ্দেশে বলেছে, মাইয়া আজই জামাইর কাছে যাইতাছে। মাইয়ারে লঞ্চ ঘাডে দিয়াহি।