ঠিক এসময় সামনের একখানা ক্ষুদ্র কুট্টির থেকে খুক খুক করে শ্লেষ্ম জড়ানো গলায় কেশে উঠল কেউ। মন্ত্রিপরিষদ নিয়ে রাজা এসে দাঁড়ালেন সেই কুট্টিরের সম্মুখে। কে। আছ, পথিককে জল দাও। ভেতরে কোনও সাড়া নেই।
রাজা আবার বললেন, কে আছ, ক্লান্ত পথিককে জল দাও।
খানিকপর একবৃদ্ধ হাতে জলের ঘট, ক্লান্ত বিষণ্ণ ভঙ্গিতে এসে দাঁড়াল রাজার সম্মুখে। জলগ্রহণের আগে রাজা বৃদ্ধকে লক্ষ্য করেন। নিম্নাঙ্গে একটুকরো বস্ত্র জড়ানো, আদুল গা। পাংশুটে মুখে দীর্ঘকালের অনাহার ছায়া ফেলছে।
রাজা বললেন, কুট্টিরে আর কেউ নেই?
না।
কোথায় গেছে?
নগরে।
কথা বলতে বৃদ্ধের কষ্ট হয়। চোয়ালে মুখ হাঁ করে শ্বাস টানছে সে। পা টলমল করছে, স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারে না।
রাজা বললেন, নগরে গেছে কেন?
ভিক্ষা করতে।
কথাটা বলে বৃদ্ধ হাত-পা দুমড়ে মাটিতে বসে পড়ে। রাজা ততক্ষণে জলপান শেষ করেছেন। ঘটিটি মাটিতে রেখে তিনিও বসেন বৃদ্ধের পাশে। মন্ত্রিপরিষদ ঘিরে আছে চারপাশ। রাজা খেয়াল করেন না।
বৃদ্ধ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, আপনারা কারা?
পথিক। বহুদূরের পথিক।
শুনে বৃদ্ধ কপাল চাপড়ায়। আহা পথিককে শুধু জল দিলাম। ক্ষমা করবেন হুজুর। ঘরে একবিন্দু অন্ন নেই। চারদিন অনাহারে আছি। সইতে না পেরে গ্রাম ছেড়ে সবাই চলে গেছে নগরে। আমার চলাচলের ক্ষমতা নেই তাই পড়ে আছি।
কতোকাল হয় দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে এখানে?
সে বহুকাল হুজুর। মানুষ মরে উজাড় হয়ে গেছে। যারা দুচারজন আছে তারা নগরে ভিক্ষা করে বেড়ায়।
তোমাদের গাঁয়ে রাজভাণ্ডারের খাদ্যদ্রব্য এসে পৌঁছয়নি?
না হুজুর। একি সেই রাজার রাজ্য, প্রজারা অনাহারে আছে দেখে রাজভাণ্ডার খুলে দেবে!
এ কথায় রাজার বুক কাঁপিয়ে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। বৃদ্ধের মাথায় দক্ষিণহস্ত রেখে রাজা বলেন, অপেক্ষায় থেকো তোমার কাছে রাজার চিঠি আসবে।
.
অপরাহ্নে রাজা ফিরে আসেন নদীতীরে। বৃদ্ধের কুট্টির থেকে বেরিয়ে তিনি মন্ত্রিপরিষদের সঙ্গে একটিও কথা বলেননি। এই দীর্ঘক্ষণ ধরে তিনি তাঁর রাজ্যের দুর্দিনের কথা ভেবেছেন। বারবার বুকের ভেতর মুচড়ে উঠেছে তাঁর। কান্না পেয়েছে। তিনি জেনে গেছেন মন্ত্রিপরিষদ তাঁর রাজ্য ছারখার করে দিয়েছে। রাজভাণ্ডার উজাড় করে দিয়েছে নিজেরা লুটেপুটে। আর রাজাকে রেখেছিল মিথ্যে একটা প্রবোধের ভেতর। ভুল জীবনে, ভুল স্বর্গে। এ জীবন রাজা চাননি। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর রাজ্যে কোনো দুঃখী প্রজা থাকবে না, অনাহারী প্রজা থাকবে না।
এ আমি কী করেছি, এ আমি কী করেছি! রাজা ভাবলেন। আমি এতকাল অন্ধ ছিলাম কেন! আমি আমার দায়িত্বে অবহেলা করেছি। প্রাসাদে বসে রাজকীয় জীবন কাটিয়েছি। কেন প্রজাদের দ্বারে দ্বারে সাধারণ মানুষের মতো যাইনি, কেন জানতে চাইনি তাদের দুঃখের কথা, অভাব অভিযোগের কথা!
নদীতীরে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাজা ভাবলেন, আমাকে আবার শুরু করতে হবে। প্রথম থেকে শুরু করতে হবে।
নদীতে পারাপারের কোনো নৌকো ছিলো না। অন্ধকার হয়ে আসছে চারদিক। এই প্রথম দীর্ঘক্ষণ পর রাজা মন্ত্রিপরিষদের দিকে তাকিয়ে বললেন, নগরে যাব কেমন করে?
মন্ত্রিপরিষদ কথা বলে না। ক্ষুধায় ক্লান্তিতে তারা খুবই কাতর। ভেতরে ভেতরে রাজার ওপর প্রচণ্ড রাগ তাদের। তাদের সব মিথ্যে প্রবোধ রাজা আজ ধরে ফেলেছেন।
এ সময় মাঝ নদীতে ছোট একখানা জেলে নৌকো দেখা গেল। নদীতে জাল ফেলে বসে আছে শীর্ণ অনাহারী পাংশু চেহারার এক জেলে।
মন্ত্রিপরিষদ চিৎকার করে জেলেকে ডাকে।
খানিক পর জাল তুলে তীরে এসে নৌকো ভিড়ায় জেলে। রাজা বললেন, ভাই জেলে আমরা নগণ্য রাজকর্মচারী। নগরে যাব।
জেলেটি বিনীত গলায় বলল, আসুন হুজুরগণ।
মন্ত্রিপরিষদ নিয়ে রাজা নৌকোয় চড়লেন।
রাজা বসেছিলেন জেলের পায়ের কাছে। অন্ধকারে জেলেটির মুখ ভালো করে দেখা যায় না। ধীরমন্থর গতিতে নৌকো বাইছে জেলে। রাজা বুঝতে পারেন জেলেটি মধ্যবয়সী। এবং ক্ষুধায়-ক্লান্তিতে কাতর।
রাজা বললেন, নদীতে মাছ কেমন?
জেলেটি খুক খুক করে বার দুয়েক কাশে। তারপর শ্বাস টেনে টেনে বলে, দুদিন ধরে জাল বাইছি। একটাও মাছ পাইনি হুজুর। একা মানুষ জাল টানা বড় কষ্টের। সংসারে কে কে আছে তোমার?
কেউ নেই হুজুর। একটা ছেলে ছিল। রাজার জন্যে যুদ্ধ করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে। একথায় রাজা ভেতরে ভেতরে চমকে ওঠেন। তবুও শীতল কণ্ঠে বলেন, রাজার লোক তোমার খোঁজখবর করেনি?
না হুজুর।
রাজভাণ্ডার থেকে মৃত যোদ্ধাদের আত্মীয়-পরিজনের জন্যে যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে তা তুমি পাওনি?
না হুজুর! আমি কেন, কেউ পায়নি। আমাদের রাজা কি আর প্রজাদের কথা ভাবেন। তাহলে রাজ্যের অর্ধেক লোক কি আর অনাহারে মরত!
রাজা আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
নৌকো তখন ওপারে এসে ভিড়েছে। নেমে যাওয়ার আগে জেলেটির হাত ধরে রাজা বললেন, অপেক্ষায় থেকো, তোমার কাছে রাজার চিঠি আসবে।
তারপর পুনরায় রাজা মনে মনে বললেন, আমাকে আবার শুরু করতে হবে। প্রথম থেকে শুরু করতে হবে।
সেদিনই রাত্রির মধ্যযামে ক্রুদ্ধ মন্ত্রিপরিষদের হাতে রাজা নিহত হন। এক বৃদ্ধকে এক জেলেকে রাজা কথা দিয়েছিলেন, অপেক্ষায় থেকো, তোমাদের কাছে রাজার চিঠি আসবে।