ততক্ষণে রাজা ও মন্ত্রিপরিষদের চারপাশ ঘিরে ভিখিরি মিছিল। শীর্ণ হাত বাড়িয়েছে প্রত্যেকে। দেখে রাজার বুকের ভেতর মোচড়ায়। সঙ্গে কিছুই আনেননি তিনি। না অর্থ না মুক্তোহার। রাজা কি এদের ফিরিয়ে দেবেন! রাজা কিছু ভেবে পান না।
মন্ত্রিপরিষদ দূর দূর করে তখন ভিখিরির তাড়াচ্ছে। সে দিকে তাকিয়ে রাজা বললেন, হোক এরা পাশের রাজ্যের। আমার অতিথি। আমার রাজ্যে কোনও ভিখিরি থাকবে না, অনাহারী থাকবে না। এদের খাদ্য এবং বাসস্থানের ব্যবস্থা করুন।
মন্ত্রিপরিষদ একসঙ্গে বলল, জো হুকুম জাহাপনা।
রাজা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
রাজা যখন নদীতীরে এসে পৌঁছুলেন তখন মধ্যাহ্ন। রোদে পুড়ে উজ্জ্বল গাত্রবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে তাঁর। মন্ত্রিপরিষদ বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে আছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। রাজার এই আকস্মাৎ রাজ্য দেখতে বেরুনো তারা পছন্দ করছে না। রাজা কখনও এরকম খেয়ালি কাজ করেননি। এতকাল রাজ্য চালাচ্ছেন, কখনো মন্ত্রিপরিষদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা না করে তিনি কোনো কাজ করেননি। মন্ত্রিপরিষদ যা বুঝিয়েছেন তাই সত্য বলে বুঝে নিয়েছেন। এই প্রথম রাজা নিজের ইচ্ছে একটা কাজ করছেন। রাজ্য দেখতে বেরিয়েছেন। তার আগে মন্ত্রিপরিষদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেননি। তাদেরকে জানাননি আমি রাজ্য দেখতে বেরুব। আমার প্রজারা কেমন আছে, আমি জানতে চাই।
এ কি তাহলে রাজার বিদ্রোহ!
মন্ত্রিপরিষদ এতকাল রাজাকে যে মিথ্যে প্রবোধ দিয়েছে, আপনার রাজ্যে কেউ দুঃখে নেই, অনাহারে নেই, আপনার রাজ্যে একজনও ভিখিরি নেই, রাজ্যে শস্য ফলছে প্রচুর, প্রজারা আপনার গুণগানে মুগ্ধ, এইসব মিথ্যের কি আজ অবসান হবে?
এইসব ভেবে মন্ত্রিপরিষদ আতঙ্কিত, ভীত। রাজা আজ স্বচক্ষে সব দেখবেন। জেনে যাবেন তার রাজ্যে কেউ সুখে নেই, অনাহারে থাকে প্রজাকুল, পথেঘাটে ভিখিরির মিছিল, অনাচার হাহাকার রাজ্যময়। রাজার গুণগান গাওয়ার মতো একটি প্রজাও নেই রাজ্যে। আর এসবের জন্যে দায়ী মন্ত্রিপরিষদ।
পরস্পর পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে মন্ত্রিপরিষদ যখন এসব ভাবছে রাজা তখন উদাস হয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে। কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে শীর্ণ খালের মতো নদী। ওপারের গ্রামপ্রান্তর মধ্যাহ্নের রোদে রুক্ষ হয়ে আছে। এপারে কোনো ছায়া নেই, হাওয়া নেই চরাচরে। দু একটা পাখি ডানায় রোদ ভেঙে উড়ে যায় ওপারের দিকে।
রাজা বললেন, আমি ওপারে যাব।
মন্ত্রিপরিষদ আবার পরস্পর পরস্পরের মুখপানে তাকায়। প্রধান ব্যক্তিটি বলে, মহারাজ আপনার কষ্ট হবে।
রাজা বলেন, আমি যাব।
তারপর খেয়াঘাটের দিকে হাঁটতে থাকেন রাজা। কেন যে তার মনে হয় আমার রাজ্যে কেউ সুখে নেই। প্রজাকুল অনাহারে আছে, ভিখিরিতে ভরে গেছে রাজ্য, অত্যাচার অনাচারে প্রজাকুলের জীবন বিপন্ন। রাজ্যের ভেতরে শুরু হয়েছে দুর্দিন, খরা। মন্ত্রিপরিষদ এতকাল আমাকে ভুল জীবনের ভেতর রেখেছে। ভুল স্বর্গে বন্দী করে রেখেছে। আমি অন্ধ ছিলাম, আমি অন্ধ ছিলাম।
ওপারে এসে রাজা দেখেন দুপাশে শস্যের মাঠ তার মধ্যিখান দিয়ে রমণীর সিঁথির মতো চিরল মেঠো পথ। মন্ত্রিপরিষদ নিয়ে সেই মেঠো পথে হাঁটতে শুরু করেন তিনি। হাঁটতে হাঁটতে রাজা উদাস বিষণ্ণ চোখে দুপাশের শস্যমাঠের দিকে তাকাচ্ছিলেন। মাঠে শস্য নেই, রোদে পুড়ে কাক হয়ে গেছে সব। দু একজন কৃষক তবুও সেই মাঠে শস্য ফলানোর চেষ্টা করছে। তাদের আদুল গা রোদে পুড়ে কুচকুচে কালো। রাখাল বালক বসে আছে বৃক্ষের ছায়ায়। শস্যমাঠ এখন গোচারণ ভূমি।
দেখে রাজা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। মন্ত্রিপরিষদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, এখানে ফসল ফলেনি কেন?
মন্ত্রিপরিষদ পুনরায় পরস্পর পরস্পরের মুখপানে তাকায়। তারপর রাজ্যে কৃষি বিষয়ক মন্ত্রি বলেন, মহারাজ এই অঞ্চলে প্রচণ্ড খরা শুরু হয়েছে, বৃষ্টি নেই। শস্যচারা বৃষ্টি না পেয়ে রোদে পুড়ে খাক হয়েছে, বৃষ্টি নেই।
রাজা গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, নদী থেকে জল তোলার ব্যবস্থা হয়নি কেন?
মন্ত্রিটি কথা বলে না।
রাজা বললেন, এই অঞ্চলে নিশ্চয় তাহলে প্রজারা অনাহারে আছে।
মন্ত্রিপরিষদ একসঙ্গে বলল, না মহারাজ সেই ব্যবস্থা আমরা করেছি, করব।
কী ব্যবস্থা?
রাজভাণ্ডার থেকে খাদ্য সরবরাহ করেছি। প্রয়োজনে আরো করব।
এই কথা আমাকে জানানো হয়নি কেন?
মন্ত্রিপরিষদ কথা বলে না।
শস্যের মাঠ শেষ হতেই একখানা গ্রাম। দূর থেকে সুন্দরী রমণীর ভ্রূরেখার মতোন কালো দেখাচ্ছিল। কাছাকাছি আসতে দেখা গেল গ্রামটি আসলে রুক্ষ। রোদে পুড়ে গাছপালা সব ধূসর বর্ণ ধারণ করেছে। হাওয়ায় শাদা ধুলো উড়ছে। গাছপালার আড়ালে গরিব প্রজাদের কুট্টির নজরে আসে। কোথাও কোনও জনমনিষ্যির সাড়া নেই। শিশু কাঁদে না, বালক ছুটোছুটি করে না, রমণীরা জল নিতে যায় না পুকুরে। একটা পাখিও ডাকে না কোথাও।
রাজার অনেকক্ষণ ধরে জলতেষ্টা পেয়েছে। গ্রামের ভেতর ঢুকে কোথাও কোনো জনমনিষ্যির সাড়া না পেয়ে জলতেষ্টার কথা ভুলে যাচ্ছিলেন রাজা।
একখানা কুট্টিরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে রাজা বললেন, এই গাঁয়ে কি প্রজা নেই?
মন্ত্রিপরিষদ একসঙ্গে বলল, নিশ্চয় আছে মহারাজ।
সাড়া নেই কেন?
আহার শেষে নিশ্চয় সুখনিদ্রায় মগ্ন তারা।