- বইয়ের নামঃ শ্রেষ্ঠ গল্প
- লেখকের নামঃ ইমদাদুল হক মিলন
- প্রকাশনাঃ মাওলা ব্রাদার্স
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
কালাকেষ্টার জীবন বেত্তান্ত
ঘোড়াটা হেলেদুলে হাঁটছে। তার পিঠে ছালার গদির ওপর একদিকেই দুপা ঝুলিয়ে বসেছে কালাকেষ্টা। বসে আরামসে বিড়ি টানছে। আজ ম্যালা খাটনি গেছে। বিয়ান রাতে ওঠে ঘোড়া নিয়ে বেরিয়েছে। গেছে পাঁচ মাইল দূরে, দিঘলীর হাটে। এখন ধান মৌসুম। পৌষের মাঝামাঝি সময়। হাটে হাটে খেপ দিয়ে বেড়ায় কালাকেষ্টা। ঘোড়ার পিঠে মহাজনের ধান সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি টেনে তবে খালাস। আজ টেনেছে জলিল ভেণ্ডারের ধান। দিঘলীর খালে কাল রাতে গিয়ে লেগেছে ভেণ্ডারের নাও দুখান। আজ বিয়ান রাতে ওঠে ঘোড়া নিয়ে সোজা দিঘলীর গেছে কালাকেষ্টা। কাল সন্ধ্যায় ভেণ্ডারের ভাইগ্না দুলাল মিয়ার সঙ্গে দেখা। বলল, কেষ্টা, মামায় কইছে কাইল সারাদিন দিঘলীর আডে থাকতে। নাও থিকা ধান টাইন্না দিবি।
কেষ্টা তো রাজিই। এটা হচ্ছে গিয়ে কাজের সময়। এখন কাজ কাম না করলে সারা বচ্ছর খাইব কী কেষ্টা! ঘোড়ারে খাওয়াইব কী!
দুলাল মিয়ার কাছ থেকে একটা বিড়ি চেয়ে খেয়েছে কেষ্টা। দুলাল মিয়া গ্রামের মাতব্বর গোছের পোলা। বয়স অল্প। হলে হবে কী, লোকে বড় মান্যিগণ্যি করে তাকে। দুলালরে খেপাইলে রক্ষা নাই। জান কবজ কইরা ফালাইব। রাইতে গিয়া বসতভিটায় আগুন দিব। গরু কোরবানি দেওয়ার চকচকে লম্বা ছুরি হাতে গিয়া খাড়াইব একলাই।
সাহস বটে মানুষটার। পেট ভরা কলিজাখান। গেলবার নয়াকান্দার ওফা মোল্লার ডাগর ডোগর মাইয়াখান তুইল্লা নিয়া গেল রাইতে। পিরীতিটিরীতি আছিল না। তাতে কী। দুলাল মিয়ার চোখে লাগছে। সারাদিন ঘুরঘুর করত মোল্লাবাড়ির চারদিকে। মাইয়াখান বড় সুন্দর মোল্লার। বড় সোন্দর শরীলটা, য্যান নতুন জোয়াইরা পানি, টলমল করে। চোখ দুইখান শাপলা ফুলের মতন। মুখখান নতুন বরজের পানপাতা। দুলাল মিয়ার চোখে লাগছিল।
মোল্লা বাড়ির লগেই নিখিল সার বাড়ি। নিখিল সা হিন্দুস্তান চইলা গেছে রায়টের সময়। বাড়িখান এখন ছাড়া। দুলাল মিয়ারা দখল নিছে। একখান ভাংগাচুরা দালান আছে বাড়িটায়, আর দেদার গাছপালা। দুলালমিয়া সারাদিন বইসা থাকত হেই বাড়িতে। মোল্লার মাইয়া ঘাটে আইলে আওয়াজ দিত। সতী মাইয়া। ভয়ে ভয়ে বাপের কাছে কইয়া দিল। মোল্লা নালিশ জানাইল ভেণ্ডারের কাছে। আহা কী কামডা করল মোল্লায়। দুলাল মিয়ারে ঘাটাইল। বুঝল না, দুলাল মিয়ার চোখ পড়ছে। এই চোখ ফিরব না।
নালিশ শুইনা ভেণ্ডারে তো ভাইগ্নারে বকল। দুলাল মিয়ার গেল মাথায় রক্ত উইঠা। গরু কোরবানি দেওনের ছুরি লইয়া রাইতে গিয়া খাড়াইল মোল্লার ঘরের সামনে। একলা মাইয়াডারে তুইল্লা আনল। এখন সেই মাইয়া দুলাল মিয়ার ঘর করে।
বিড়ি টানতে টানতে কেষ্টা গতকাল সাহস করে দুলাল মিয়াকে জিজ্ঞেস করেছিল, বিবির খবর কী মিয়া? ভালো নি?
দুলাল মিয়া বলল, পোলা অইব।
অ্যাঁ!
হ। সাত মাস চলছে।
শুনে দাঁত কেলিয়ে হেসেছে কেষ্টা। দুলাল মিয়া টানতে টানতে এক হাতে বাবুর হাটের লুঙ্গি বাঁ হাটুর ওপর তুলে কালির খিলের বিশাল মাঠ ভেঙে মিলিয়ে গিয়েছিল।
কেষ্টার তখন একটা দীর্ঘশ্বাস পড়েছিল। বয়স হইল দুই কুড়ির ওপর। এখনও ঘর হইল না কেষ্টার, সংসার হইল না। হইব হইব কইরা ভাইংগা গেল।
তারপর বৈচির কথা মনে পড়েছে কেষ্টার। কানা বেলদারের মাইয়া। বেলদার পাড়ার। সর্দার আছিল কানা। বাঁও চক্ষুটা নাই কানার। পদ্মার চর দখল লইতে গিয়া খোয়াইছিল। ডাকাইত একখান। বুড়া বয়সেও তাগদ কী শইল্লে! মাথায় গোল টুপি। লাগাইয়া কানা এখন হাটেবাজারে যায়। কেষ্টার লগে দেখাসাক্ষাৎ হয়। মানুষটারে দেখলে শইলটা কাপে কেষ্টার। বুকের মইধ্যে বাজাইরা খোদাই ষাড় গোঁত্তা দিয়া ওঠে। হইলে অইব কী, মাইনষেরে কিছু কইতে পারে না কেষ্টা। মনের রাগটা মনেই রাখে। জগৎসংসারে একলা মনুষ কেষ্টা। ভাইবেরাদর কেউ নেই। মাইনষের লগে শত্রুতা কইরা ফায়দা কী কেষ্টার! রাইতের আন্ধারে আইসা কেষ্টার কল্লা কাইট্টা থুইয়া গেলে দেখব কেডা! কেষ্টারে বাঁচাইব কেডা!
কানা বেলদার সর্দার মানুষ। ম্যালা জোতজমিনের মালিক। সাতখান আছে কেরাইয়া নাও। এক কুড়ির ওপরে ঘোড়া। খরালিকালে ঘোড়ার কারবার একচেটিয়া কানার। বাইষ্যাকালে কেরাইয়া নাওয়ের কারবার। নাইওর আনে, নাইওর নেয়। পয়সা, খালি পয়সা। কয় বচ্ছর আগে সাতঘইরার গাঙ্গে চর জাগল। কানা বেলদার লাইঠাল লইয়া হেই চরের দখল লইল। বেলদার পাড়াটা তারবাদে উইঠা গেল সাতঘইরার হেই চরে। বেলদাররা এখন কানার পোরজা। কানা হইল চরের মালিক। রাজা মানুষ।
পাড়ার বেবাক বেলদাররা ঐ কানার কথায় পুরানা পাড়া ছাইড়া সাতঘইরার চরে চইলা গেছে। যায় নাই কেবল কেষ্টা। কানা কইছিল, আইয়া পর কেষ্টা। কালীর খিলে বেলদাররা কেওই নাই, তুই একলা পইড়া থাকবি কেন? আয়, আমি তরে জমিন দিমু। বিয়া করাইয়া দিমু। বউবেটি লইয়া সুখে-শান্তিতে থাকবি।
কেষ্টা গেল না। বাপের ভিটা ছাইড়া যাইতে কষ্ট হয়।
ভিটা বলতে ভিটা। দশ কদম মতো জায়গা। একখান খাজুর আর কয়খান বিচ্চাকেলার গাছ। মধ্যিখানে একখান ছাপড়া ঘর। একখান ঘোড়া আর কেষ্টা। এই তো সংসার। হইলে হইব কী, কেষ্টা এসব ছাড়তে রাজি না। তাছাড়া কেষ্টার মনে ভেতর লুকিয়ে। আছে আর এক দুঃখ। কানা বেলদারের ওপর আছে বিশাল এক ক্রোধ। কেষ্টার সেই দুঃখটা বৈচি। কানা বেলদারের মাইয়া।