সুরুযবানু ওকে আবার পাঠাল কবিরাজের কাছে। প্যাচা যোগাঢ় করা খুব কঠিন কাজ। উনি পোকার (ছোট্ট অণুর মতো কালো পোকা বর্ষাকালে মশার মতো। কামড়ায়) নয় মণ দুধও হবে না রাধাও নাচবে না। মদন আবার যাক, সহজ কোন অযুদ আছে কিনা জিজ্ঞেস করে আসুক। টাকা যতো লাগে, সে দেবে—আর না হয় যদি এমন কোন দাওয়াই হারে কাছে থাকে খেলেই ঘুম আসে, আর ভাঙে না সে ঘুম সেই দাওআই যেন দিয়ে দেয়, সে নিজেই খেয়ে নেবে। কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলে গেছে সুরুয বানুর। বুজি তারা সারা রাত ঘুমায় না। কান্দে। সোনার শরীর কি হয়ে গেছে। না, আত্মীয় নয় পাড়ার ছেলে মদন কিন্তু সুরুয বানুদের সঙ্গে এমন একটা বংশানুক্রম সম্পর্ক সুরুবানুদের জন্য চিরকাল প্রাণ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থেকেছে। মদনরা। সেই কথা বুজিয়ে দেখে মনে এল মদনের, নবীন যুবক মদন। সেদিন ভোরে যখন ওরা সবাই আবিষ্কার করল বাড়িতে তারু মিয়ার এক বছরের পুরনো নতুন বিছানায় নদিনা নেই, মদন নেই, তখন অনেকদিন পর স্বামীর সামনে এসে দাঁড়াল সুরুয বানু। স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে রীতিমতো সহজ সুরে বলল, একটা মানুষ পালাইয়া কই যাইবো। আপনে লোক পাঠান, যেখানে পায় ধইরা আনবো।
তারুমিয়া কথা শুনে চমকে উঠল। এই একটি বছর একবারও সুরুয বানুর কথা, সুরুব্বানুর মনের কথা ভাব্বার কথা মনেও আসে নি। সে যে ভিতরে অনেক নিদারুণ কষ্ট পেতে পারে সেকথা একবারও মনে আসেনি। সতীনকে ছোট বোনের মতো আদর করেছে তাতেও অসঙ্গতি দেখেনি। কিন্তু নদিনার চলে যাওয়ায় তার খুশি হওয়ার কথা নয়? কিন্তু ও কোন্ কথা বলছে সে?
তারু মিয়া বলল, যে চইলা গেছে তারে ধইয়া আনলে তুমি খুশি হইবা?
সুরুয বানু বলল, আমি অই বা না হই আপনে তো খুশি হইবেন। ব্যাস তাইলে হইলো। আপনের সুখ ছাড়া আমার আলাদা কুন সুখ নাই।
এর জবাব তারুমিয়া দিনের বেলা এত মানুষের ভিড়ে দিতে পারেনি কান্নার মতো যে মহব্বতের দলাটা সমস্ত শরীরে জমেছিল, তাকে নামিয়ে দিল রাত্রে দুজনে একসঙ্গে। নামাজের পরে অবসন্ন কন্ঠে তারু মিয়া বলল, আমরা দুজনেই শহরে যাব, ডাক্তার দেখাব, কতো জাতের অষুদ বাইর হইছে আজকাল। ডাক্তার পরীক্ষা কইরা কইতে পারবো, কার দোষ।
তখন সুরুয বানু ভাল একটা প্রশ্ন করল, যদি আপনের দোষ থাকে, তাহলে? তাহলে আমি অষুধ খাব।
অষুধ যদি না থাকে?
তারু মিয়া ওকে আবার জড়িয়ে ধরে। সত্যিই কিইবা আর করতে পারে সে।
অস্থির অশ্বক্ষুর – আবদুল মান্নান সৈয়দ
স্যার, আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিলো। মেয়েলি কণ্ঠে থমকে দাঁড়াই। তাকিয়ে দেখি একটি ছাত্রী, আমারই। বুক কি একটু কেঁপে ওঠে না? এখনো ঠিক অজর অক্ষর অধ্যাপকে পরিণত হই নি তো, একটু হাওয়া দিলেই কোথায় বাঁশপাতায় কাঁপন ধরে। সেই কাঁপন যথাসম্ভব আড়াল করে, স্বাভাবিক গলায় বলি, কী, বলুন। ছেলেদের সঙ্গে ‘আপনি-তুমি’ এলোমেলো করে ফেলি, মেয়েদের সঙ্গে অদ্বিধ ‘আপনি’ ছাড়া আর কোনো সম্বোধন আসে না আমার। কোনো-কোনো সহকর্মী অধ্যাপকের মতো মেয়েদের সঙ্গে অনায়াসে তুমি বলতে পারি না।
আপনি তো, স্যার, নজরুলগীরি ভক্ত। আমি একটু-আধটু নজরুলগীতি গাই–কাল সকালে রেডিওতে আমার প্রোগ্রাম আছে একটা, আপনি যদি শোনেন—
বাহ–নিশ্চয় শুনবো বাহ, খুব ভালো তো–ততোক্ষণে আমার ভেতরের কাঁপুনি বন্ধ হয়েছে। মেয়েটিকে চিনি, বিবি ডাকনাম, তা-ও কবে যেন কীভাবে জেনেছিলাম; ভালো নাম আফরোজ জাহান। সকাল সাড়ে-আটটায় এদের সঙ্গে ছোট একটি ক্লাস ছিলো আমার। তারপর সারাদিন মুক্তি। তখনো কলেজের মাঠে ভোর বেলার সুঘ্রাণ লেগে আছে, কলেজের পুরনো বিশাল বিল্ডিংয়ের উপরে রোদ এখনো কাঁচা তাজা স্বচ্ছ স্নিগ্ধ রল সোনালি, বহুদিনের পুরনোর ওপরে নতুন সূর্য এসে পড়েছে।
২.
বুকের ভেতরে কবিতার ছেঁড়া উড়ো পঙক্তিমালা ঘোরে। আর কিছু নয়, ঘুরে-ঘুরে আজ মাত্রাবৃত্তে বাঁধবো তোমাকে, এই একটা লাইন ঘূর্ণিহাওয়ায় এক টুকরো কাগজের কুঁচির মতো কেবলি উড়ে-উড়ে ঘোরে। দিনরাত্রি রক্তের ক্ষরণ / এইখানে রাখো দেখি সিগ্ধ শাদা গভীর চরণ’— মেঘমেঘালির মধ্যে ওড়ে শাদা চাঁদ, অফুরন্ত মেঘমেঘালির মধ্যে এই ক্ষীণ শাদা চাঁদ। একা হতেই ক’একটি শব্দ মৌমাছির মতো ঘিরে ধরে। মনে পড়ে বিবির চোখ যেন কলেজের কঠিন বিল্ডিং ও বাস্তবতার বাইরে অন্য কোনো দিগন্তের নীল আভাস দিচ্ছিলো; যেন তার কণ্ঠে লেগেছিলো না বলা বাণীর আভা।
৩.
আম্মা বললেন, মন্টু, দিলিনে এ মাসে?
দিচ্ছি শিগগিরই।
কবে আর দিবি। মাসের অর্ধেক হয়ে গেলো। সংসার কী করে চলে, তা তো বোঝে না। চালের দাম বেড়েছে আবার, তার খোঁজ রাখো? আমার হয়েছে যতো জ্বালা। দিনরাত কবিতা লিখলে কি আর সংসার চলে?
আমি হাসি, আম্মা, মনে আছে আপনার প্রথম যেদিন টেলিভিশনে কবিতা পড়লাম? বাড়িশুদ্ধ কী উৎসাহ আপনাদের সবার। আর এখন…।
আশ্চর্য, আম্মা হাসেন না তারপরও, কঠিন মুখ করে রাখেন। আমিও ভেতরে ভেতরে তিক্ত হতে থাকি। সময়, আমার সময়। বেলা হলে সমস্ত শিশির যায় শুকিয়ে। জীবন, ওগো জীবন।
৪.
বিবির মা বাপ সৌজন্য সাক্ষাৎকার সম্পন্ন করে চলে গেলে আমি ভেতরে-ভেতরে হাঁপ ছেড়ে বাঁচি। বিবির ছোট একটি কৌতূহলী ভাই উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিলো, বিবি কোথায় তাকে সরিয়ে রেখে আসে। এতোক্ষণ পর আমি স্বাভাবিক হয়ে উঠি। আমি সিগারেট খাই না, বু একটা খেতে ইচ্ছে হয় এখন। শাড়ি পরে নি আজ বিবি, লতাপাতায় আচ্ছন্ন পাজামা কামিজে ওকে একটা বাচ্চা মেয়ের মতো লাগে। সব মিলিয়েই ওকে আজ ‘তুমি’ বলে ফেলি।