প্রশ্ন করে তারু মিয়া, আসল কথাটি কি মদন?
মদন চুপচাপ পেছ পেছ হাঁটতে লাগল। মদনকে তার পেছনে লাগানো হয়েছে, এটা সে টের পেয়েছে, এটা সে পছন্দ করছে না, এসব কথা এই মুহূর্তে মদনকে বলা হবে কিনা ভাবল খানিক তারু মিয়া। মদনকে সে সাবধান করে দিতে পারে, ভবিষ্যতে যদি তার পেছনে পেছনে আসতে দেখে তাহলে দুটো পার একটাও আস্ত থাকবে না, কিন্তু, এতো তাড়াহুড়ো করে কিছু করা ঠিক হবে না। বিষয়টা ঘোলাটে হোক তা সে চায় না। বরং ভালয় ভালয় এর শেষ দেখতে চায় সে।
মদন?
জি দুলাভাই?
আমাকে পাহারা দেওয়ার লাগি পাঠায় তোমার বুজি?
জে, রাইতে আন্ধাইরে কত কি হইতে পারে ত, তয় বুজি কয় থাকিস মদনা তানির লগে লগে।
২.
কোন ওজর-আপত্তি অশ্রুর মিনতি, চিৎকারের শাসানি টিকল না। নদিনা ভর বয়সী, মাছের মত শক্ত আর পিচ্ছিল শরীর, বেহায়া যৌবন আর আদরের রসে ভেজাগলা নিয়ে তারু মিয়ার সংসারে প্রবেশ করল, তারু মিয়ার কোন উপায় ছিল না। পৃথিবী একদিকে থাকলেও অন্যদিকে থাকতো নদিনা আর তারু মিয়া। আরে জীবনে সুখই না পেলাম তো কি দরকার সে জীবন দিয়ে। তাছাড়া, একটা অজুহাত যখন আছেই। অজুহাত, আবার ভয়। বাইরে সে যতই বলুক সে কাউকে পরোয়া করে না, সে নিজের বংশরক্ষার জন্য যা ভালো মনে করেছে তাই করেছে, ভিতরে ভিতরে ভয়টা ছিলই। সুরুয বানুর সঙ্গে তার অন্যরকম সম্পর্ক। অভ্যাসের সম্পর্ক, সংসারের সম্পর্ক, সুরুয বানু, এ সংসারে নেই একথা তার পক্ষে চিন্তা করা কঠিন।
ভাবনা ছিল, নদিনাকে সুরুয বানু গ্রহণ করবে না, কিংবা দু’জনে খুব লাগবে। বলে না দুষ্টলোকে কারো সঙ্গে দুশমনি থাকলে তাকে দুই বিয়ে করিয়ে দাও? সেরকম অশান্তি হবে ভেবেছিল। দু’জনের ঝগড়ার ঠেলায় বাড়িতে কোন কাক আসবে না, কুকুরগুলো ভেগে যাবে। এ গাছ লাগাবে তো সে গাছ কাটবে। এ শুকাবে তো সে ভিজাবে। এমনি।
কিন্তু না, সুরুয বানু সেদিন দিয়েও গেল না।
বরং ছোটবোনকে যেমন, তেমনি নদিনাকে বরণ করে নিল। ওক বলল, তুমার কি দোষ? তুমি তো তুমার সংসারে আসছে। দোষ আমার, আমার কপালের। লক্ষ্মী হইয়া আসছে, লক্ষ্মী হইয়া থাকবা।
কিন্তু তারু মিয়ার সঙ্গে কোন কথা নেই তার। তার দিকে ভুলেও তাকানো নেই। সংসারের কোন কথা নেই।
শাশুড়ি বানেছ। বিবি কেবল মাথা চাপড়ান, আমার সুখের সংসার আছিল, কি শাস্তি আছিল, সংসারে এখন শয়তান আসছে আমি টের পাইতাছি। কপালে শাস্তি না থাকলে জ্বর কইরা মানুষে শান্তি পায়?
তিনি কি যে দেখেছিলেন সংসারে, কিসের ছায়া তা তিনিই জানেন।
এমন করে আদর দিল নদিনাকে সুরুবানু সে গলে গেল। সবাই অবাক হলো, অবাক হওয়ার কথা। জিনিসটা অস্বাভাবিক, বড় সতীনের জান হয়ে গেল ছোট সতীন এটা কে কবে কোথায় শুনেছে। কিন্তু এই কথাটি কারো মনে ঢুকল না। বাইরের চেহারা দেখে মানুষ বিচার-আচার করে বটে।
৩.
আরজান কবিরাজ মদনকে পাত্তাই দিল না। তার মতো পোলাপানের আবার সাংসারিক সমস্যা কি? মদন বলল যে বিষয়টা তার নয়, তার বোনের। বোন তো পর্দানসীন, তায় অনেকদূরে বাড়ি। তার পক্ষে সম্ভব নয়। আসলে অসুখ তার নয়, অসুখ তার বোনের। আরজান কবিরাজ বলল, যার অসুখ তাকে আসতে হবে, রোগী। না দেখে অযুদ কিসের?
মদন নাছোড়বান্দা, বলল, সকলেই বলে, আপনে বড় ভালো কব্রিজ। এখন বুঝতেছি কেন আপনের এত নামডাক।
হাসল আরজান কবিরাজ, বলল, বুঝতাছে?
হ।
তাহলে যাও, বইনরে লইয়া আস গিয়া।
মদন একটু ইতিউতি করে। বলে, আমার নিজের একটা অসুখ আছে।
কি অসুখ?
মদন লজ্জা পাওয়ার ভান করে। তারপর সঙ্কোচ করে। যেন কিছুতেই কথাটা মুখ দিয়ে রে হচ্ছে না। কব্রিজ উৎসাহ দেয়, বলে, কও কইয়া ফালাও।
শরম লাগে।
অসুখ নিয়া শরম কি? কও।
পকেট থেকে একটা একশ টাকার নোট বের করে দেয় মদন। সঙ্গে সঙ্গে প্রসন্ন হয়ে ওঠে কব্রিজের চেহারা। দ্বিগুণ উৎসাহে হুঁকোয় টান দেয় আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখ ছোঁকরাকে। নিশ্চয়ই ভালবাসার অসুখ। কাউকে সমস্তটা মন দিয়ে আছে কিন্তু তার মন পাচ্ছে না। এই বয়সে কবিরাজ প্রশ্ন করে, কাউকে ভালবাস?
মাথা দোলায় মদন।
সে তুমারে বাসে না?
বাসে।
তবে?
আরেকজন আছে। সে থাকতে আমার কোন আশা নাই।
তারে কি করতে চাও?
মদন বলে, সে জন্যই ত আপনার কাছে আসছি।
কবিরাজ অনেকক্ষণ চিন্তা করল। নতুন তামাক ভরল। টিকা লাগিয়ে ফু দিল। তামাকের ধোঁয়ার ভুরভুর গন্ধে ঘর ভরে গেল। আবার নতুন উদ্যমে বেশ কয়েকবার ঘন ঘন টান দিলে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে যেন অনেক দূরের কি দেখলে।
বললে, তারে সুরাইয়া দিবা একেবারে?
জে?
কিন্তু–
গলার স্বর নামিয়ে আনল কবিরাজ আরজান, কিন্তু তাতে অনেক খরচ হবে, অনেক বিপদ।
মদন পকেট থেকে আরো একশ টাকার একটা নোট বের করে হাতে দেয়। কবিরাজের চোখ চকচক করে ওঠে।
বলে, ওর সাথে খারি দিবা। দাওয়াত কইরা খাওয়াইবা। প্যাঁচা আছে না? পাচার কলজা খাওয়াইবা।
খাওয়াইলে?
ব্যস। সাবধান, কেউরে কইবা না। কইলে তুমিই বিপদে পড়বা। আমি তুমারে চিনি-টিনি না। যাও।
৪.
কোনদিক দিয়ে যে সময় বয়ে যায়। আজকে কালকে করতে করতে কেমন করে একটি বছর পার হয়ে যায়, কেমন করে সহ্যের সীমা আর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়ে নিজেই দড়ি নিয়ে ঝুলে পড়বে কিনা সিদ্ধান্ত নিতে বসে সুরুয বানু, নিজেই টের পায় না। নদিনার পেটের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকে অধৈর্য হয়ে যায় তারু মিয়া, বানেছা বিবি। প্যাচা ধরা সে যে কী ভীষণ কঠিন কাজ তা হাড়ে হাড়ে জানে মদন। এর মধ্যে ওকে আর ছেলেমানুষ লাগে না, পুরু গোঁফ প্রায় মুখ ঢেকে ফেলেছে। প্যাচার কলিজা খাইয়ে এমন একটা সোনার টুকরো মানুষকে মারবে, যতই সে ভাবে আর। নদিনাকে দেখে, নদিনার জন্যে একটা কাঁচা কচি মায়ার ভাব তার বুকে ভিতর কান্নাকাটি শুরু করে। একটা মানুষকে কেমন করে মারবে সে যেখানে নিজেই সে মরে আছে। নদিনার কথারও কোন ট্যাকসো নেই। সেদিন তাকিয়ে ছিল তার মুখের দিকে অনেকক্ষণ, ও যে কেমন করে ওর অমন বাণ-মারা চোখে বিদ্ধ করে, হু হু করে তখন বুক কেঁপে উঠল, ওকে প্যাচার কলজে সে খাওয়াতে পারবে না, তখনই নদিনা ওকে এক অসম্ভব লোমকাঁপানো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে বসল, অমন আর কতদিন খালি তাকাইয়া থাকবা? এবং তখন মদন একটু সাহস করে প্রশ্ন করল, আর কি করব? নদিনা মাথা সোহাগভরে মৃদু নাড়িয়ে চোখে ঢেউ তুলল এবং একটু এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল ক্যান আর কিছু করার নেই? সব রোগের দাওয়াই আছে, খালি আমার রোগের নেই।