উঠানে নেমে ডালিমতলায় চলে গেছে ততক্ষণে তারু মিয়া। ওখান থেকে কি রকম একটা মিনমিন করে চিবানো জবাব দিল টের পাওয়া গেল না। পরদিন সারাদিন সুরুয বানু তক্কে তকে থেকেছে ভাল করে কথাটা জিজ্ঞেস করার জন্যে ভাল করে। একটা জবাব পাওয়া পর্যন্ত বুকের ভিতরে একটা অচেনা দুপদাপকে কিছুতেই দূরে সরাতে পারছে না। কিন্তু সারাদিন তাকে একান্তে পাওয়া খুব কঠিন কাজ। শাশুড়ি আছে, দেবর ননদ আছে, আছে সারাদিন গুচ্ছের কাজ। হাঁড়ি ঠেলাঠেলি, ধান শুকানো, রকারি সাজানো। অথচ সারাটা দিন তার কিছু ভাল লাগেনি। মনে হয়েছে ডালিম গাছের পাতাগুলো হঠাৎ কবে-হলদেটে হয়ে গেছে। ধরতে ধরতে সেই রাতে খাবার সময়। ভাত দিয়েই প্রশ্নটা করল সুরুয বানু, কই যান কইলেন না?
কইলাম যে কালকে! অবাক হয় তারু মিয়া।
কি কইলেন, বুঝলাম না। ভাল কইরা কন।
আমার কথা তুমি বুঝ না?
তারুমিয়া তার বড় বড় চোখ মেলে এমন করে তাকাল, মুহূর্তে বিভ্রম হলো সুরুয বানুর। এবং তার ফলে একটু হেসে বিষয়টাকে হালকা করতে চায় সে, বলে, কথা পরিষ্কার কইরা না কইলে কেমনে বুঝব কন।
তারু মিয়া বলে, সব কথা পরিষ্কার কইরা কওয়া যায়?
ঘরে এসে আবার ঢোকে তারু মিয়া। ফিসফিস করে বলে, বাজারে নতুন এক বুড়া আইছে কবিরাজ। অনেক রকমের অষুধ জানে।
ব্যস এক কথায় সুরুয বানুর সমস্ত দ্বন্দ্ব কেটে ফর্সা হয়ে গেল। পেটের ভিতর কোন গুমর রাখতে নেই। রাখলে নিজেরও কষ্ট পবেরও কষ্ট।
কিন্তু প্রতিদিন যেতে হবে কেন? কিছু কিছু কথা কানে আসছে তার যার ফলে সমস্ত ব্যাপারটাকে আর হালকা করে দেখা যাচ্ছে না। সত্য, তাদের সাড়ে দশ বছরের বিবাহিত জীবনে কোন আনন্দ আসেনি কোলে-পিঠে। যখনই গরীব মানুষের কোন বউয়ের দিকে তাকায় সুরুয, মনটা খাঁ-খাঁ করে ওঠে। অভাগিদের এতো এতো তার একটাও নেই। পাড়ার কোন মেয়েকে বাচ্চা-কোলে দেখলে তার তলপেটে মোচড় দিয়ে ওঠে, হাত প্রসারিত হয় আপনা-আপনি। স্বামী আর শাশুড়ি বিশেষ করে এই দুজন মানুষ তাকে যত ভালবেসেছে এমন আর কেউ বাসেনি। এই দুজন মানুষ এখন যেন সমস্ত মায়া মহব্বত প্রত্যাহার করে নিয়েছে। শিকেয় যত্ন করে সাজিয়েছিল যেন এক বিচিত্র সুন্দর বৈয়ম এখন কে যেন শিকে খালি করে ফেলেছে, বৈয়ম নেই। বয়সের ভারে, বাতাসের ভারে ঝুলছে ন্যাংটা শিকে।
তারু মিয়া চেষ্টা করছে করুক। কিন্তু রোজ রাতের বেলা এত রাত পর্যন্ত। কবিরাজ বাড়িতে কি করতে হয় তার?
সুরুয বানুর এখানে বিশ্বাসী মানুষ নেই। বাপের বাড়ি থেকে খবর দিয়ে একটা মানুষ আনতে হলো। মদন। বিশ একুশ বয়েস। বড় চটপটে। কাজের। বিশ্বাসী।
বাজার বেশি দূরে নয়। বাড়ি থেকে বাইরের উঠান পার হয়ে উত্তরদিকে মোড় নিলেই তো আব্বার কবর। যেখানে এলে দিন হোক রাত হোক গা ছমছম করে। তারপর বুড়ি আম গাছ। কতোকাল ওর আম খেয়েছে তারু, ওর গায়ে চড়ে, ঘাড়ে চড়ে বুকে বসে। অন্ধকারে গাছটাকে ভূত-ভূত লাগে। তারপরই জেলা বোর্ডের রাস্তা, পুবে-পশ্চিমে। না এই রাস্তায় রাত হোক বিরাত তোক কোন ভয় নেই এলাচিপুরের মানুষের। এখানে না আছে কোন গোপনীয়তা, না কোন ফাটাফাটি। দদিকের ধান ক্ষেত রোদের মতো ফর্সা। রাতে শীতল বাতাস। পশ্চিম দিকে ফার্লং খানেক হাঁটলেই হাট বাজার। শনি-মঙ্গল হাট বসে। রোজ সকালে বসে দধের হাট। আর সকাল সন্ধ্যা কয়েকটা চায়ের দোকান, একটা অষুধের দোকান হা করে থাকে। ইস্কুল কলেজের কিছু নতুন ছেলেছোঁকরা ওখানে গুলতানি মারে। অদূর যেতে হয় না তারু মিয়ার। বাজারে ঢুকতেই আগে যে একটা ঘর ছিল ছোট, হরদম মজত থাকতো নানান জাতের জিনিসপত্র। আর পঞ্চাননের হাসি মুখ, সেইটে। ঘরটা একটু বড় হয়েছে। এখন। ঘরটার সামনে দিয়ে গেলেই বিভিন্ন অদ্ভুত জিনিসের আনচান করা গন্ধ নাকে লাগে। সেই গন্ধের টানে ঘরে ঢুকতে ইচ্ছে করে। না, তারু মিয়া ওখানে নিজের ইচ্ছায় ঢোকেনি।
বাজার হইল বড় মানুষের পুত?
কথা শুরু করার কায়দা বটে।
হ-হ, চাচা।
তামুক খায়া যাবা একখান?
মন্দ কি? ঢুকল তারু মিয়া, ঘরটা ঠাণ্ডা। মেঝেয় খালি পা পড়তেই সমস্ত শরীর যে জুড়িয়ে গেল তা নয়, মেঝের ঠাণ্ডা পা দিয়ে ঢুকে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। এবং বিভিন্ন অষুধের মিশ্রিত গন্ধ নাকের ভিতর দিয়ে একেবারে বুকে এসে বসে গেল, মনে হলো, কোন মাতোয়ালীর নাঙ্গা বুকে তার বুক মিশল বুজি।
তারু মিয়া টুকেই বলে সরল মনে, ঘরটা ত আপনার খুব ঠাণ্ডা চাচা, মনে হয় শরীর জুড়াইল।
খিল-খিল করা বুকের পোকা-সাফ করা একটা হাসি ভিতর থেকে বের হয়ে এল তখন। কান গরম হয়ে উঠল তারু মিয়ার। একে শীতল মেঝে, তারপর কোবরেজি গন্ধের বাহার, তারপর সেই হাসি।
কন্ধেয় টিকে লাগিয়ে ফুঁ দেয় আরজান কবিরাজ। লম্বাটে মুখ, পাতলা দাড়ি, টানা-টানা তরল চোখ আর কেমন স্যাঁত-সেঁতে গলা। টানে খুব। কাটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে আরজান কবিরাজ প্রশ্ন করেছিল, সুখ ও শান্তি কও, টাকা কও পয়সা কও; তদবির ছাড়া কিছু হয় না। ঘরে বইসা থাকলে কাম হয় না, তদবির করন লাগে। এই যে অত বড় সংসার, এত ধান চাউল, তুমি না থাকলে খাইবো কেডায়?
কি করুম চাচা, আল্লায় দেয় নাই।
তদবির না করলে আল্লায় কেমনে দিব? ভালা কইরা চাও তার কাছে।