তখন কেন না শুয়ে পড়ব! কাকলির রাগের স্বরটা কৌতুকের মত শোনাল।
আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এতটুকুও কি বিচলিত হবে না সুকান্ত? বলা যায় না কঘণ্টা করাত্তির এমনি বন্দী থাকতে হয় আমাদের।
করাত্তির!
তা ছাড়া আর কি। কিছুই তো সাড়াশব্দ পাচ্ছি না কোথাও। আর সবই যখন অন্ধকার, নিশ্চল নিঃশব্দ, তখন রাত ছাড়া আর কি। প্রত্যেকটি মুহূর্তই এক গহন রাত্রি। কথাটা তা নয়
তা নয়? চোখ তুলল কাকলি।
না। আপনি যদি নিতান্ত শুয়েই পড়েন আমি না হয় এই মেঝেতেই কুকুরকুণ্ডলী হব, নিরীহের মত ঘুমুব শান্তিতে।
ঘুমুবেন? পারবেন ঘুমুতে?
দেখুন না পারি কিনা। হাসতে লাগল সুকান্ত।
আপনার এতটুকু ভয় করছে না?
কেন করবে? কিসের ভয়? সঙ্গী যদি ভালো হয় মানে সৎ, কি বলে, সুন্দর হয়, তা হলে ভয় থাকে না। সেই কারণে আপনিও নির্ভয় হতে পারেন হয়তো। পারেন না?
কিন্তু আপনি কি সুন্দর?
সুন্দর ভাবলেই সুন্দর। একটু লাজুক হবার ভঙ্গি করল সুকান্ত : সুন্দর না হই, সৎ তো বটে। ভালো মানে ইউনিভার্সিটির ভালো ছেলে নই। ভালো মানে ভালোবাসার ভালো ছেলে। কিন্তু কথাটা তা নয়–
তা নয়? কাকলির চোখে কে গাঢ় করে কালো রেখা টেনে দিল।
না। আমি বলছিলাম আপনার বাবার কথা। বলছিলাম, যখন শেষ পর্যন্ত আপনাকে বসতে হবেই, তখন আগেভাগেই বসে পড়ন। আমার দরকারি কথাটা সেরে নিই।
দরকারি কথা! একটু বা চমকাল কাকলি। বললে, এই বিপদে কারু আবার দরকারি কথা থাকে নাকি? থাকলেও মনে পড়ে নাকি?
পড়ে। কে জানে হয়তো ঐ দরকারি কথার জন্যেই এই বিপদ। ঢোঁক গিলল সুকান্ত : কথাটা আর কিছু নয়, আপনার বাড়ির ঠিকানাটা ভুলে গেছি–
ভুলে গেছেন মানে? চমকে উঠল কাকলি, কোনোদিন জানতেন নাকি?
জানতাম।
কি করে? কে বললে?
কেউ বলে নি।
তবে?
চোখের উপর স্থির চোখ রাখল সুকান্ত, আপনিই লিখেছিলেন।
আমি? চোখের পলক ফেলল না কাকলি, আপনাকে?
হ্যাঁ, আমাকেই। আর কাকে?
লিটটা ফের চলতে শুরু করল নাকি? যেন একটু দুলে উঠেছিল, নিজেকে সামলাল কাকলি। দেখল লিফটের নয়, হৃৎপিণ্ডের দোলা।
কী লিখেছিলাম? চিঠি?
তা তাকে চিঠি ছাড়া আর কী বলে?
বাঃ, আমি আপনার ঠিকানা জানলাম কি করে? কাকলি প্রায় ঝংকার দিয়ে উঠল।
সে চিঠি আমার বাড়িতে পোস্টে পাঠান নি। তাই আমার বাড়ির ঠিকানা না জানলেও চলে। সেটা আমাকে কলেজেই পৌঁছে দিয়েছেন এবং বেয়ারা মারফৎ। কি, মনে পড়ে?
খুব একটা নির্দোষ ব্যাপার, এমনি হালকা হওয়ার ঢেউ তুলে কাকলি বললে, কলেজ সেমিনারে কোনো বক্তৃতা ব্যবস্থা করে দেবার জন্যে অনুরোধ। মনে পড়েছে। কি, তাই না?
হ্যাঁ তাই। গর্বের নিশ্বাস ফেলে সুকান্ত বললে, আমাদের গলিতে থাকেন এক বিখ্যাত সাহিত্যিক, তাকে সেমিনারে ধরে নিয়ে এসে কিছু বলাবার জন্যে প্রার্থনা—
প্রার্থনা! বাক্যের নির্বাচনে আপত্তি কাকলির।
নয়তো বলুন আদেশ। আপনি যখন সেমিনারের সেক্রেটারি তখন আপনার বলাই হুকুম করা। কিন্তু, একটু কান চুলকোল সুকান্ত : কোথাও একটু মিনতিও হয়তো ছিল। নচেৎ, কোনো দরকার নেই, ঐ চিরকুট চিঠিতে ফলাও করে আপনি আপনার বাড়ির ঠিকানা লিখে দিয়েছিলেন কেন?
দিয়েছিলাম বুঝি? চোখের কোলের কাছটিতে লজ্জার রেখা ফোঁটাল কাকলি : ওটা কেমন হাতের টানে অভ্যেসের বশে এসে গিয়েছিল।
তাই হবে। কিন্তু কী বিচ্ছিরি ঠিকানা। বাড়ির নম্বর নয় তো ধারাপাতের অঙ্ক। ধারাপাতের অঙ্ক বলা ভুল হল, কেননা তাতে একটা শৃঙ্খলা থাকে। আপনাদের নম্বরটা তো অঙ্ক নয়, আতঙ্ক। কোনো ছিরিছাঁদ বা নিয়মকানুন নেই। তিন শ তিয়াত্তর না ছ শ সাতাত্তরের সতেরো, তার আবার বাই-সাতাশ না সাতাশি। কখনো এমন বিদঘুটে নম্বর হয় শুনেছেন? মুখচোখ গম্ভীর করল সুকান্ত : সতেয়োর সাতাশ না সাতাশের সতেরো এই ঠিক করতেই প্রাণান্ত। তারপর ঐ তিন শ তিয়াত্তর–আচ্ছা, বলুন, অমন কখনো নম্বর হয়?
এত বিপদেও মানুষে হাসে! দিব্যি হাসি বেরুল কাকলির বললে, মোটেই তিন শ তিয়াত্তর নয়।
নয়! তবেই দেখুন কিরকম অসম্ভব গোলমেলে ব্যাপার, কারু সাধ্যি আছে তা মনে রাখে!
মনে রাখবার কী দরকার! চিরকুটটা দেখে নিলেই পারেন।
চিরকুট বলতে আপনার লেগেছে বুঝি। চিরকুট বলুন বা গেট-পাশ বলুন, দলিলটা হারিয়ে গেছে। মুখ অবিশ্বাস্য করুণ করল সুকান্ত : আমার সব জিনিস খালি হারায়।
তাই দেখছি। স্মৃতিশক্তি ধৃতিশক্তি দুই-ই। মুখ টিপে একটু হাসল কাকলি।
ধৃতি-শক্তি মানে?
ধরে রাখবার শক্তি। না পারলেন ঠিকানাটা মনে রাখতে, না বা চিরকুটটা ধরে রাখতে। অতএব আপনাকে ঠিকানা দিয়ে লাভ কি।
আর না দিলেই বা ক্ষতি কি। নৈরাশ্যে মুখ ধূসর করল সুকান্ত : কে জানে এই পিঞ্জরই হয়তো আমাদের শেষ ঠিকানা।
তাই যদি হবে, এই পিঞ্জরই যদি আমার শেষ বাড়ি, বেশ সরল হতে পারছে কাকলি, তবে ঘটা করে প্রাক্তন বাড়ির খোঁজ করছিলেন কেন?
বুঝতে পারছি, অনর্থক করছিলুম। সুতরাং, সুকান্ত সিটের দিকে ইঙ্গিত করল, আসুন, হতাশ হয়ে বসে পড়ি।
না, হতাশ হবার তো কিছু দেখছি না। সহাস্য নির্ভয়ে বলতে পারল কাকলি, খাচার বাইরে কোথাও এক আকাশ আছে। সমস্ত জনতার মধ্যেও আছে এক নির্জনতা।
এত সুন্দর করে কথা বলতে পারে নাকি কেউ? কাকলির চোখের মধ্যে তাকিয়ে রইল সুকান্ত।
কথাটা শেষ করেনি কাকলি। জের টেনে বললে, সমস্ত ঠিকানার বাইরে মানুষের আরেক বাসস্থান।