- বইয়ের নামঃ প্রথম কদম ফুল
- লেখকের নামঃ অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ ছোট গল্প
প্রথম কদম ফুল
খাঁচার দরজাটা খুলে দিতেই ব্যস্ত পায়ে ঢুকে পড়ল কাকলি। আর তক্ষুনি কোত্থেকে হন্তদন্ত হয়ে হাজির সুকান্ত।
লিফটম্যান এক পলক তাকাল আগন্তুকের দিকে। কিন্তু সুকান্ত তাকে দ্বিধা করতে দিল না এতটুকু। অবধারিতের মত ঢুকে পড়ল।
উপায় নেই, প্রায় গা ঘেঁষেই দাঁড়াল কাকলির।
অন্তত, একে প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়ানোই বলে। একটা চারকোনা বাক্স, জায়গা কম, এ কে না জানে। তবু এরই মধ্যে বরাদ্দ দুরত্ব রাখা অসম্ভব ছিল না, শালীন দূরত্ব। লিফটম্যানের ওপাশের দেয়ালের দিকে হেলতে পারত অনায়াসে। এ যেন হৃৎপিণ্ডে মারবে বলে ছুরি উঁচিয়ে এসেছে। কিংবা শাড়ির বুনটটা হাতে নিয়ে উদাসীন মমতায় দেখবে পরখ করে। দাম জিজ্ঞেস করবে।
বিরক্ত মুখে কাকলি বললে, আপনি! আপনাদের–
হ্যাঁ, আমাদের, ছেলেদের বারণ। তবে যারা রুগ্ন, যাদের হার্ট দুর্বল—
আপনি কি রুগ্ন?
কাকলির চোখে একটু বা প্রশংসার রঙ মাখা।
না। হাসি-হাসি মুখে সুকান্ত বললে, তবে, বলতে বাধা নেই, হৃদয় বড় দুর্বল।
হার্টের মানে বুঝি হৃদয়? বলবে না ভেবেছিল তবু কথার পিঠে বলে ফেলল কাকলি।
আরো একটা মানে করা যায়। বললে সুকান্ত : আঘাত। প্রহার। যন্ত্রণা।
কথা বললেই কথা বাড়ে, চুপ করে রইল কাকলি। কয়েক সেকেণ্ডের তো মামলা। এখুনি উঠে আসবে তেতলা। বারোটা চল্লিশে তার ক্লাস।
কিন্তু এখন হার্টের যে অবস্থা, মানে যে রকম বুক কাঁপছে, সহজেই ডাক্তার সার্টিফিকেট দিয়ে দেবে, সিঁড়ি ভাঙা বিপজ্জনক, লিফটই প্রশস্ত। বুক-ফুলিয়ে নিশ্বাস নিল সুকান্ত : তবে ক্ষুদ্র হৃদয়দৌর্বল্য ত্যাগ না করলে কিছু হবার নয়।
কাকলি চোখ নিচু করে রইল। কিন্তু, এ কি, লিফট হঠাৎ আটকে গেল মাঝখানে। দোতলা আর তেতলার মধ্যে। ঘোর-ঘোর আধছায়ার রাজ্যে।
কি সর্বনাশ! প্রায় আর্তনাদ করে উঠল কাকলি।
কারেন্ট অফ হয়ে গিয়েছে বোধ হয়। লিফটম্যানের হয়েই যেন বললে সুকান্ত।
তার কথা কে গ্রাহ্য করে? সে তো চালাচ্ছে না। সে কলকজার জানে কি!
কারেন্ট অফ হয়ে গিয়েছে? চোখ কপালে তুলে লিটম্যানকে জিজ্ঞেস করলে কাকলি।
কল বিগড়ে গিয়েছে। নিশোতনের মত বললে লিটম্যান।
এ যেন তেমনি একটা নিস্পৃহ-নিশ্চল থাকবারই অবস্থা। দুহাতের মুঠি তুলে অস্থিরের মত কাকলি বললে, তা হলে কী হবে?
যতক্ষণ না কারেন্ট আসে অপেক্ষা করতে হবে। বললে সুকান্ত।
আর যদি অন্য কোনো গোলমাল হয়? কাকলির মুখ আতঙ্কে প্রায় সাদা।
যতক্ষণ মিস্ত্রি না আসে—
বলেন কি। ততক্ষণ ঝুলব ত্রিশঙ্কুর মত? কাঠ-কাঠ গলায় বললে কাকলি।
কিন্তু নিঃশঙ্ক হয়ে। যেন খুব একটা আনন্দের ব্যাপার, পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে আগা-পাশ-তলা মুখস্থ জানা উত্তর—এমনি উৎসাহ সুকান্তর ভঙ্গিতে।
নিঃশঙ্ক হয়ে? ভিতরে ভিতরে মৃদু-মৃদু কাঁপছে যেন কাকলি : বলতে চান কোন ভয় নেই?
না, কিসের ভয়? যেন এক পা এগিয়ে এল সুকান্ত : আমিই তো আছি।
ইঙ্গিতটা বুঝি লিফটম্যানকে। মানে লিফ্টম্যান যদি অশোভন কোনো আচরণ করে তবে প্রতিকর্তা স্বয়ং সুকান্ত। যেন সুকান্তের থেকে কোনো ভয় নেই। সে যেন বনে বাঘ নয়, ঘরে কালসাপ নয়। সে এক দেবশিশু।
আর সত্যি, লিটম্যানের ব্যবহারকেও বলিহারি। কলকজা যদি কোন খারাপ হয়ে থাকে, তবে হাতের যন্ত্রপাতি নিয়ে কিছুটা নাড়াচাড়া করবে তো, বুঝুক বা না বুঝুক, কোথাও করবে তো একটু তদন্ত-তদারক। তা নয়, ঠায় দাঁড়িয়ে আছে অনড় পুতুলের মত। লক্ষ্য নিজের দিকে নয়, অন্য দুই আরোহীর দিকে।
চেঁচাবে? শুনতে পাবে কেউ? শুনলেই বা উদ্ধার করবে কে? কে করবে সাহায্যের তোড়জোড়?
ছটফট করতে লাগল কাকলি।
আপনি অত নার্ভাস হচ্ছেন কেন? সুকান্ত বললে, বসুন সিটটায়। বিশ্রাম করুন।
ঝলসে উঠল কাকলি : এটা এখন বিশ্রাম করবার সময়?
উপায় কি। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন দু পায়ে? বললে সুকান্ত। পা ধরে গেলে এক সময় বসতে তো হবেই।
এখনো ধরে নি।
আমার উপরে অকারণ চটছেন। আমি ভালো কথাই বলছি। কখন মেরামত হয়ে লিফট আবার চালু হয় ঠিক নেই। চাই কি এই সিটটায় বসে ঘুমুতেও হতে পারে–
ঘুমুব এখানে? করুণ কান্নার মত করে বললে কাকলি। আর আপনি?
যদি জায়গা দেন—
এখানে জায়গা কোথায়? কাকলি দেয়ালের কোণ ঘেঁষে দাঁড়াল।
জায়গা নেই, জায়গা নেই এই তো এই যুগের হাহাকার। আরো কিছুটা যেন এগিয়ে এল সুকান্ত : সেটা তো স্থানের দিক থেকে, প্রাণের দিক থেকে নয়। কেননা, যদি হৃদয়ে জায়গা থাকে তা হলে ঘরে কেন, খাঁচায়ও জায়গা আছে। ঐ যে কি বলে, যদি হয় সুজন তেঁতুল পাতায় দুজন—দুজন নয় নজন। কথাটা হয়তো ঠিক তা নয়। কথাটা হচ্ছে, আমি যাব কোথায়? যতই কেননা রাগ করুন, এই মুহূর্তে আমাকে ফেলবারও তো কোন জায়গা নেই। সুতরাং–
আরো কি এক চুল এগিয়ে এল নাকি সুকান্ত? আপনার শাড়ির উপর এ কি একটা ছারপোকা না ভেঁয়ো পিঁপড়ে এই অছিলায় গায়ে হঠাৎ হাত দিয়ে ফেলবে নাকি? কাকলি আরো কুঁকড়ে গেল, শিটিয়ে গেল।
সুতরাং, আসুন সিটটায় বসি। সুকান্ত সরে দাঁড়াবার ভঙ্গি করল।
আপনিও বসবেন?
বাধা কি। এটা তো আর ট্রাম বাস-এর লেডিজ সিট নয়! এখানে সবাই পাশাপাশি, সবাই সমানসমান।
আপনি বসুন। আমি দাঁড়িয়ে থাকব।
কিন্তু কতক্ষণ থাকবেন! সুকান্ত দার্শনিক হবার ভান করল, মানুষ কখনো কোনো অবস্থায়ই খুশি নয়। কেবলই সে ভোল বদলাচ্ছে, ভঙ্গি বদলাচ্ছে। দাঁড়িয়ে আছেন-দাঁড়িয়ে আছেন, মনে হবে কতক্ষণে একটু বসতে পাব। বসে আছেন-বসে আছেন, মনে হবে কতক্ষণে একটু পা টান করে শুতে পাব। শুয়ে আছেন—শুয়ে আছেন, মনে হবে, আর নয়, এবার উঠে পড়ি। উঠে পড়েছেন কি, আবার সেই বসে পড়ার, শুয়ে পড়ার জন্যে কান্না। সুতরাং যতই কেননা দাঁড়ান, দাঁড়িয়ে থাকুন, বসতে ইচ্ছে করবেই আপনার এক সময়, আর যখন বসবেনই শেষ পর্যন্ত–