- বইয়ের নামঃ সমাজ সাহিত্য ও দর্শন
- লেখকের নামঃ হেমন্ত কুমার গঙ্গোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই, দর্শন
অতিশয়োক্তি ও কাব্য
ঠাকুর্দা নাতিকে গল্প বলছেন : একবার আমার ছোটবেলায় সে যে কী গরম পড়েছিল তোরা ভাবতে পারবি না। আমাদের গ্রামের পুরুতঠাকুর আর এক গ্রামে পূজো করতে গিয়েছিলেন। পূজো শেষ হতে দুপুর হয়ে গেল। যজমান বাড়ীর লোকেরা বলল, ঠাকুর আর বাড়ী যাবেন না। এ প্রচণ্ড রোদে ঘর থেকে বেরুলে আর বাঁচবেন না। ঠাকুরের কিন্তু বাড়ী ফিরে আসতেই হবে। জরুরী কাজ আছে। বাইরে একটিও জনমানব নেই, ঠাকুর একাই চলছেন। রোদের তাপে তার হাত-পা-নাক-কান সব গলে গলে মাটিতে ঝরে পড়তে লাগল। কিন্তু সূৰ্য্যদেব ঠাকুরের টিকিটকে কিছুতেই গলাতে পারল না। জোকের মত বুকে হেঁটে টিকিট শেষ পৰ্যন্ত বাড়ী গিয়ে পৌঁছাল। বাড়ীর লোকে দেখল। দরজার চৌকাটের তলা দিয়ে একটা বড় জোক গলিয়ে আসছে। কাছে গিয়ে দেখতে পেল জোক নয়, ঠাকুরের টিকি। পুরুতের প্রাণ টিকির ভিতরেই কিছুক্ষণ ধূক ধূক করে নিভে গেল।
ঠাকুর্দার এই গল্পটিতে আলঙ্কারিকের অতিশয়োক্তি পরাকাষ্ঠা লাভ করেছে। অতিশয়োক্তি না হলে অলঙ্কার জমে না, অলঙ্কার না হলে কাব্যও জমাট বঁধে না। আমাদের প্রাচীন আলিঙ্কারিক আচাৰ্য্য দণ্ডী একটা দামী কথা বলেছেন-অতিশয়োক্তি সমস্ত অলঙ্কারের একমাত্র অবলম্বন। ইংরেজি figure of speech-এর চেয়ে সংস্কৃত ‘অলঙ্কার’ শব্দটি বোধ হয় বেশী সার্থক, কারণ এ শব্দটির মধ্যে এমন একটি প্রয়োজনীর ব্যঞ্জনা আছে যা ইংরেজি প্রতিশব্দটিতে নেই। মেয়েদের অলঙ্কার একটি বাহুল্য বা আতিশয্য যা শোভাবৃদ্ধিতে সাহায্য করে; কাব্যকথায় অলঙ্কারও এমনি একটা আতিশয্য যা কাব্যকে হৃদয়গ্ৰাহী করে তুলতে সাহায্য করে।
এরিষ্টোটেল রাজনৈতিক বাক্ষ্মীদের বাগবৈদগ্ধ্য শিক্ষা দেবার জন্য অলঙ্কার শান্ত্রের অবতারণা করেন। অতিশয়োক্তি না হলে বাগিতা দিয়ে বিপক্ষকে ঘায়েল করা যায় না, বক্তৃতার জৌলুস খোলেনা, শ্রোতার হাততালি জোটেনা। সুতরাং এরিষ্ট্যোটেলও দণ্ডীর মত অতিশয়োক্তিকেই তার অলঙ্কারশান্ত্রের সারা বলে ঘোষণা করতে পারতেন। দণ্ডীও বলেছেন, অতিশয়োক্তি হল “বাগীশমহিতা উক্তি’-বাক্যাধীশদের বন্দনীয়া উক্তি। বৈষ্ণব কবিদের অনেক আগেই দণ্ডী তাঁর অভিসারিকাকে জ্যোৎস্না রাতে সাদা অভিসারে পাঠিয়েছেন। সাদা মল্লিকার মালায় মাথা ঢেকে, শ্বেত চন্দন মেখে, সাদা শাড়ী জড়িয়ে গৌরী তন্ধী অভিসারিকা পূর্ণিমারাতে অভিসারে চলেছে। কোনো অভিভাবক পুলিশ পাঠিয়েও এই অভিসারিকাকে ধরতে পারবে না, সে যে চন্দ্ৰালোকে একাকার হয়ে মিশে গেছে। পাঠক কিন্তু ঠিকই ধরতে পারবে, তার বৈষয়িক দৃষ্টির সামনে পূর্ণচন্দ্রের জ্যোৎস্নাতেও কোনও অভিসারিণী সর্বশুক্ল হয়েও মিলিয়ে যেতে পারে না। কিন্তু পাঠককে তার বৈষয়িক চোখটি বন্ধ রাখতে হবে, কাব্যদৃষ্টি উল্মীলিত করে এই বিচিত্র অতিশয়োক্তির রসটুকু উপভোগ করতে হবে।
সুতরাং সাহিত্যে অতিশয়োক্তি শুধু সহনীয় নয়, উপভোগ্যও বটে। অতি কঠোর বাস্তববাদী সাহিত্যিক ও অতিশয়োক্তি ছাড়া এক কলম লিখতে পারবেন না। অকাল-প্ৰয়াত কিশোর কবি মাত্র আটটি ছোট্ট পঙক্তিতে নিরন্ন মানুষের ক্ষুধার যাতনাকে প্ৰকাশ করলেন। নিছক ব্যবহারিক দৃষ্টিতে ঐ ছোট্ট কবিতাটির প্রত্যেক পঙক্তিই তো অতিশয়োক্তি–
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় :
পূর্ণিমাচাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।
সোজা কথাকে এত বাঁকাবার কি দরকার ছিল। বললেই হত—’ক্ষুধার জালায় জ্বলছি, তোমাদের কাব্যটাব্য শিকায় তুলে রাখ। কিন্তু এ হলেও হবে না। ‘শিকায় তুলে রাখ’-ওটাও তো কাব্যিক বাহুল্যই হল। কাব্যের বইগুলো সত্যিই তো আর রান্নাঘরের শিকায় তুলে রাখতে বলা হচ্ছে না। তবে বাহুল্য বর্জন করতে হলে কি বলতে হবে? কাব্যকে কবর দাও, আগুনে পুড়িয়ে ফেল? এতেও হল না। বাহুল্য রয়েই গেল। আর কবি যা বলতে চেয়েছেন তার কিছুই বলা হল না। কথাগুলিকে যতই সাদাসিদে আটপৌরে করার চেষ্টা করুন না কেন, কাপ্পার খোলুটা অর্থের তুলনায় অনেক বড় হতে বাধ্য। যদি বলা যায় ক্ষুধার সময় কাব্যের ঘ্যান্যাননি বন্ধ করা, কথাটা একদম বাস্তবধর্মী হল কি? কবির বক্তব্য কি ছিল, আর আমরা কোথায় নেমে এসেছি সে বিচার এখন থাক। আমরা একান্ত জৈব জৈব যাতনা কি ভাবে প্ৰকাশ করব সে কথাই ভাবছি। অনুভূতির তীব্রতা-প্ৰকাশকে নিতান্ত বাস্তবধর্মী করতে হলে ভাষার মাধ্যম পরিত্যাগ করতে হবে। আর্তনাদ, চীৎকার, ছটফটানি, মাটিতে গড়াগড়ি, ভাবপ্রকাশের এই আদিম জাস্তব ভঙ্গীগুলোকেই আমাদের গ্ৰহণ করতে হবে। তাহলে আমরা মাটির কাছাকাছি পৌঁছব সন্দেহ নেই, তবে এহেন কবির জন্য কোন কবিগুরু কান পেতে থাকবেন না।
আধুনিক কবিতা চিত্ৰকল্পসৃষ্টির উপর গুরুত্ব আরোপ করে বাস্তবধর্মী হতে চাইছে। মনে পড়ে কোথায় যেন কোন এক আধুনিক কবিতায় দ্বিতীয়ার চাঁদকে নারিকেল ফলার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল। বেরসিক পাঠক নিশ্চয়ই জিজ্ঞাসা করবেন-কবির সনা কি নারকেল রসাস্বাদে অনেকদিন বঞ্চিত ছিল? জীবনানন্দ বলেছেন-‘শিং-এর মত বাঁকা নীল চাঁদ।‘ কবি কি কোনদিন ষণ্ডরাজের শৃঙ্গাঘাতে কাতর হয়েছিলেন? না হলে বঙ্কিম চাঁদ দেখে বাঁকা শিং-এর কথা মনে পড়ল কেন? দিনেশ দাস কাস্তে হাতে ধান কাটেন নি। তবু বাক চাঁদ দেখে তার কাস্তের কথা মনে হয়েছে“এ যুগের চাঁদ হল কাস্তে”। প্রাচীন কবিরা আকাশের চাঁদকে সুন্দরী রমণীর মুখ পৰ্যন্ত নামিয়ে এনেছিলেন। কিন্তু আধুনিক কবিরা তাকে নারিকেল ফলা, গরুর শিং, রুটি ও কাস্তে পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন। এর মধ্যে নারকেল-ফলা ও গরুর শিং-এর চিত্রকল্প কবির ভাবনাকৃতির বৈচিত্রমাত্র। কিন্তু কাস্তে ও ঝলসানো রুটি শুধুমাত্র চিত্রকল্প নয়, বিবর্তিত সমাজ-চেতনার এক সুগভীর প্রতিচ্ছবি ব্যঞ্জনাবৃত্তি-বাহিত হয়ে চিত্রাকারে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ইতরজনের বস্তুদৃষ্টিতে এই চিত্ৰকল্পগুলিতেও অতিশয়োক্তি রয়েছে—চাঁদ শিং বাগিয়ে গুতোঁতে আসে না, কাস্তে হয়ে ধান কাটতেও যায় না।