ঘটনাটা এইবার বলছি। একটি ছোটোখাটো চেহারার অ্যাংকোলে শিকারি কম্যান্ডার গণ্ডিকে তাদের মহিষ-শিকারের পদ্ধতি দেখাতে রাজি হয়েছিল। অবশ্য লোকটি আগে সাহেবের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছিল যে, কোনো কারণেই তিনি উক্ত শিকারিকে বাধা দিতে পারবেন না এবং শোচনীয় দুর্ঘটনার সম্ভাবনা দেখলেও গুলি চালাবেন না। একটা উঁচু গাছের ওপর কম্যান্ডার সাহেব যখন বসলেন, তখনই অ্যাংকোলে-শিকারি তার কর্তব্যে মনোনিবেশ করল।
মুক্ত প্রান্তরের উপর এখানে-ওখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল ছোটো ছোটো হলুদ রং-এর ঘাসঝোপ। ওইরকম একটি ঘাসঝোপের ভিতর ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল লোকটি। অস্ত্রের মধ্যে তার সঙ্গে ছিল তির-ধনুক আর একটা ছোটো ছুরি।
গাছের উপর থেকে খুব মনোযোগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করে সাহেব আবিষ্কার করলেন, দূর প্রান্তরের সীমানায় যেখানে এক সারি সবুজ ঘাস আত্মপ্রকাশ করেছে, সেইখানে বিচরণ করছে অনেকগুলো কৃষ্ণকায় চতুষ্পদ মূর্তি–মহিষ!
প্রান্তরের বুকে তৃণভোজনে ব্যস্ত মহিষযুথের পিছনে বাঁ-দিকে অবস্থান করছে এক ভীষণদর্শন পুরুষ মহিষ। সাহেব বুঝলেন ওই জন্তুটাই হচ্ছে দলের প্রহরী এবং অ্যাংকোলে-শিকারির লক্ষিত জোবি–ওকেই হত্যা করার চেষ্টা করবে ছোটোখাটো মানুষটি।
গাছের ওপর থেকে সাহেব দেখলেন ঘাসঝোপের ভিতর থেকে হঠাৎ মহিষের খুব কাছেই আবির্ভূত হল একটি মনুষ্যমূর্তি–অ্যাংকোলে-শিকারি!
লোকটি হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। গাছের ওপর থেকে তার শরীরটা সাহেবের দৃষ্টিগোচর হলেও মাটিতে দাঁড়িয়ে মহিষের পক্ষে লোকটিকে দেখা সম্ভব ছিল না। লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে চটপট ধনুক থেকে তির নিক্ষেপ করে মাটিতে শুয়ে পড়ল। ধনুকের টংকার-শব্দ সাহেবের কানে এল। সঙ্গেসঙ্গে একটা সংঘাতের আওয়াজ এবং জান্তব কণ্ঠে অস্ফুট ধ্বনি–মহিষের স্কন্ধে বিদ্ধ হয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে একটা তির।
সর্বনাশ, সাহেব মনে মনে বললেন, এইবার তিরবিদ্ধ মহিষ নিশ্চয়ই হাঁক দিয়ে দলকে সংকেত জানাবে। সেই শব্দ শোনামাত্র মহিষের দলটা ছুটে আসবে অ্যাংকোলে-শিকারির দিকে।
সে-রকম কিছু হল না। আহত মহিষ একটা অস্পষ্ট আওয়াজ করল, বিরক্তভাবে দুই-একবার মাথা নাড়ল, মনে হল একটা বিরক্তিকর মাছিকে সে তাড়াতে চেষ্টা করছে–তারপর চারদিকে সঞ্চালিত করল তীক্ষ্ণদৃষ্টি যেন এক গোপন শত্রুকে সে আবিষ্কার করতে চাইছে!
উদবেগজনক কয়েকটি মুহূর্ত… মহিষযূথ সরে যাচ্ছে দূরে… সঙ্গীদের গতিবিধি লক্ষ করছে তিরবিদ্ধ মহিষ। সে এখনও বুঝতে পারছে না সঙ্গীদের অনুসরণ করা উচিত, না তাদের ফিরেআসার জন্য হাঁক দেওয়া উচিত। মহিষ তার কর্তব্য স্থির করার সময় পেল না, আংকোলে শিকারি নি মাটিতে। দ্বিতীয় তিরটা ঘাড়ের ওপর লোকটিকে সে দেখতে পায়নি বটে, তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে আবার বলল তির ছুড়ল, তারপর শুয়ে পড়ল মাটিতে। দ্বিতীয় তিরটা ঘাড়ের ওপর বিঁধতেই খেপে গেল মহিষ। লোকটিকে সে দেখতে পায়নি বটে, কিন্তু শ্রবণেন্দ্রিয়ে ধরা পড়েছে ধনুকের অস্পষ্ট টংকার ধ্বনি–শব্দের দিকনির্ণয় করতেও মহিষের ভুল হল না।
যেদিক থেকে শব্দ এসেছে, সেইদিকেই ছুটল মহিষ… কিন্তু সোজা নয়–বৃত্তের আকারে গোল হয়ে ঘুরে জন্তুটা সঙ্গেসঙ্গে মাথা উঁচুকরে বাতাস থেকে শত্রুর গায়ের গন্ধ পাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। সাহেব যে গাছটার উপর আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেই গাছ আরশায়িত নিগ্রো শিকারির মধ্যবর্তী স্থানের মাঝামাঝি এসে মহিষ বোধ হয় মানুষের গায়ের গন্ধ পেল, সে থমকে দাঁড়াল, বার বার বাতাসে ঘ্রাণ গ্রহণ করল তারপর আবার কয়েক পা এগিয়ে বাতাস শুঁকতে লাগল… অবশেষে মানুষটাকে সে আবিষ্কার করে ফেলল। ঠিক যে জায়গায় নিগ্রো শিকারি, সেই দিকেই ছুটল মহিষ। দিকনির্ণয়ে তার একটুও ভুল হয়নি, পদভরে মাটি কাঁপিয়ে সে ধেয়ে এল উল্কাবেগে।
গাছের উপর থেকে সাহেবের মনে হল, ধরাশায়ী মানুষটার ওপর এসে পড়েছে একজোড়া প্রকাণ্ড শিং, এই বুঝি হতভাগ্য শিকারিকে মাটিতে গেঁথে দেয় একজোড়া জান্তব তরবারি। কিন্তু সেই রক্তাক্ত দৃশ্যে সাহেবের দৃষ্টি পীড়াগ্রস্ত হওয়ার আগেই অকুস্থল থেকে একটি ধুলোর মেঘ লাফিয়ে উঠে তার দৃষ্টিশক্তিকে আচ্ছন্ন করল। একটু পরেই জোর বাতাসের ধাক্কায় সরে গেল ধুলো। সাহেব দেখলেন, অ্যাংকোলে-শিকারি অক্ষত অবস্থায় মাটিতে আর তার সামনেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে মহিষ। জন্তুটা অস্থিরভাবে মাটিতে পদাঘাত করছে এবং তার নাসিকা ও কণ্ঠ থেকে উদগীর্ণ হচ্ছে অবরুদ্ধ রোষের ভয়াবহ ধ্বনি।
কম্যান্ডার সাহেব স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে দেখলেন মহিষ পিছন ফিরল। কিন্তু না–অত সহজে রেহাই দিল না যমদূত ক্ষণিকের জন্য লাফিয়ে সরে গিয়েছিল মহিষ, তৎক্ষণাৎ ঘুরে এসে আবার মানুষটাকে পরীক্ষা করতে লাগল সে।
লোকটি একটুও নড়ছে না, তার ধরাশায়ী দেহে কোথাও জীবনের লক্ষণ নেই। তার সর্বাঙ্গে পড়ছে মহিষের তপ্ত নিশ্বাস, কানে আসছে রক্ত-জল-করা গর্জনধ্বনি, খুরের আঘাতে কাঁপছে তার পাশের মাটি–তবু অ্যাংকোলে-শিকারির দেহ নিস্পন্দ, নিশ্চল!
সাহেব অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন, নিজের ওপর কতখানি কর্তৃত্ব থাকলে ওই অবস্থায় মড়ার ভান করে পড়ে থাকা যায়!