আচম্বিতে জ্বলন্ত ঝোপ ভেদ করে তিনটি মানুষের সামনে আবির্ভূত হল ক্রুদ্ধ মহিষাসুর!
মহিষ ছুটে এল মানুষগুলির দিকে।
গর্জে উঠল ক্যাথার্লির রাইফেল। দুর্ভাগ্যবশত গুলি লাগল মহিষের মাথায়–ইস্পাতের মতো কঠিন অস্থি-আবরণের ওপর ফেটে গেল রাইফেলের টোটা!
দ্বিগুণ বেগে ধেয়ে এল মহিষ!
একজন মডি সভয়ে আর্তনাদ করে উঠল, তারপর পিছন ফিরে পা চালিয়ে দিলে তিরবেগে। অভাগা জানত না যে ধাবমান শিকারের দিকেই সর্বাগ্রে আকৃষ্ট হয় হিংস্র পশু
মহিষ তৎক্ষণাৎ লোকটিকে অনুসরণ করল।
আবার অগ্নদগার করে গর্জে উঠল ক্যাথার্লির রাইফেল উপরি-উপরি দু-বার।
গুলির আঘাতে মহিষ হাঁটু পেতে বসে পড়ল।
যে-লোকটি ছুটে পালাচ্ছিল সে ততক্ষণে প্রায় বাঁশবনের কাছে এসে পড়েছে পিছন দিকে দৃষ্টিপাত করে সে দেখল মহিষ ভূতলশায়ী, সে থেমে গেল।
সগর্জনে উঠে দাঁড়াল মহিষ, শরীরী ঝটিকার মতো ধেয়ে এল পলাতক শিকারের দিকে। মডি যুবক ছুটতে শুরু করল, বাঁশবনের অন্ধকারের গর্ভে অদৃশ্য হয়ে গেল ধাবমান দ্বিপদ ও চতুস্পদ, শিকার ও শিকারি… ।
রাইফেল বাগিয়ে ক্যাথার্লি ছুটলেন তাদের পিছনে।
একটা বাঁক ঘুরতেই ক্যাথার্লি দেখলেন মহিষ প্রায় লোকটির ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে। আবার গুলি চালালেন শিকারি, তার লক্ষ্য ব্যর্থ হল। পরক্ষণেই মহিষের নিষ্ঠুর শিং দুটো লোকটিকে মাটির ওপর ফেলে দিল–ক্যাথার্লি দেখলেন নিগ্রো যুবকের পৃষ্ঠদেশ বিদীর্ণ করে আত্মপ্রকাশ করেছে এক ভয়াবহ ক্ষতচিহ্ন!
একবার আর্তনাদ করেই লোকটি মৃত্যুবরণ করল।
মহিষ এইবার ক্যাথার্লির দিকে ফিরল।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে শিকারি সভয়ে আবিষ্কার করলেন তার রাইফেলে আর একটিও গুলি নেই! কম্পিতহস্তে তিনি তাড়াতাড়ি নূতন টোটা ভরার চেষ্টা করতে লাগলেন…
ক্যাথার্লির সামনে এসে পড়ল মহিষ।
তখনও তিনি টোটা ভরার চেষ্টা করছেন–এখনই বুঝি একজোড়া ধারালো শিং-এর আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় শিকারির দেহ…
অকস্মাৎ একটি দীর্ঘাকার মানুষ লাফ দিয়ে ছুটে এল মহিষের দিকে টোনিও!
পিছন দিকে শরীর দুলিয়ে সামনে ঝুঁকে পড়ল টোনিও–জীবন্ত বিদ্যুৎরেখার মতো শূন্যে রেখা কেটে ছুটে এল তার হাতের বর্শা এবং মুহূর্তের মধ্যে মহিষের চিবুক ভেদ করে চোয়ালের দুই দিকে ঝুলতে লাগল বর্শার লৌহদণ্ড!
মহিষ ওই আঘাত গ্রাহ্যই করল না, নীচু হয়ে ক্যাথার্লির উদ্দেশে প্রচণ্ডবেগে চালনা করল ভয়ংকর দুই শৃঙ্গ
কিন্তু ব্যর্থ হল তার আক্রমণ।
তার চোয়ালে আবদ্ধ বর্শার দুই প্রান্ত আটকে গেল দু-পাশের বাঁশগাছে।
শিং-এর পরিবর্তে তার মাথাটা ধাক্কা মারল শিকারির দেহে এবং সেই দারুণ ধাক্কায় ছিটকে। মাটির ওপর চিৎপাত হয়ে পড়ে গেলেন ক্যাথার্লি।
মহিষ তার শিং দুটিকে নামিয়ে আবার শিকারির দেহে আঘাত করার চেষ্টা করল।
তার চেষ্টা সফল হল না। চোয়ালে আবদ্ধ সুদীর্ঘ লৌহখণ্ডের দুই প্রান্ত আবার আটকে গেল ধরাশায়ী শিকারির দুই পাশে অবস্থিত ঘনসন্নিবিষ্ট বাঁশগাছের গায়ে।
বার বার সজোরে ঝাঁকানি দিয়েও ক্রুদ্ধ মহিষ বর্শাটাকে কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারল না, তার চোয়াল বিদ্ধ করে মুখের দু-পাশে কাঁপতে লাগল টোনিওর বর্শা–এদিকে চার ফুট, ওদিকে চার ফুট!
ক্যাথার্লি তখনও প্রাণের মায়া ছাড়েননি, কম্পিত হস্তে তখনও রাইফেলের টোটা ভরতে চেষ্টা করছেন।
কিন্তু তার চেষ্টা বুঝি সফল হয় না–
মহিষ হঠাৎ পিছনের দুই পায়ে উঠে দাঁড়াল, এইবার তার সামনের দুই পা প্রচণ্ড বেগে এসে পড়বে শিকারির বুকের ওপর, সঙ্গেসঙ্গে ভেঙে যাবে শিকারীর বক্ষপঞ্জর
ঠিক সেই মুহূর্তে ছুটে এল টোনিও, তারপর মহিষের মুখের দু-ধারে বিদ্ধ বর্শাদণ্ডের এক প্রান্ত ধরে মারল হাচটা টান!
কী অসীম শক্তি সেই বন্য যুবকের দেহে দারুণ আকর্ষণে ঘুরে গেল মহিষ, আবার ব্যর্থ হল তার আক্রমণ!
ভীষণ আক্রোশে ঘুরে দাঁড়িয়ে নূতন শক্তিকে আক্রমণ করার উপক্রম করল মহিষাসুর, আর সঙ্গেসঙ্গে ক্যাথার্লির রাইফেল সগর্জনে অগ্নিবর্ষণ করল।
কর্ণমূল ভেদ করে রাইফেলের গুলি মহিষের মস্তিষ্কে বিদ্ধ হল, পরমুহূর্তেই মাটির ওপর লুটিয়ে পড়ল সেই ভয়ানক জানোয়ারের প্রাণহীন দেহ।
এতক্ষণ পরে ক্যাথার্লি তার রাইফেলে গুলি ভরতে পেরেছেন!
ক্যাথার্লির মতোই আর একজন সাদা চামড়ার মানুষ স্থানীয় নিগ্রোদের অদ্ভুত সাহসের পরিচয় পেয়ে চমকে গিয়েছিলেন। ওই ভদ্রলোকের নাম কম্যান্ডার এ গন্ডি। তিনি ছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একজন সৈনিক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর পূর্বোক্ত সৈনিক কিছুদিন আফ্রিকার বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেছিলেন। সেই সময় আফ্রিকার অ্যাংকোল জাতীয় নিগ্রো শিকারিদের মহিষ শিকারের কৌশল স্বচক্ষে দেখেছিলেন তিনি। মানুষ যে ঠান্ডা মাথায় কতখানি সাহসের পরিচয় দিতে পারে, স্নায়ুর ওপর তার সংযম যে কত প্রবল হতে পারে, তা দেখেছিলেন কম্যান্ডার গন্ডি–ধনুর্বাণধারী এক অ্যাংকোলে শিকারির বীরত্ব তাকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল।
তদানীন্তন বেলজিয়ান কঙ্গের যে অঞ্চলে অ্যাংকোলে জাতি বাস করত, সেই জায়গাটা প্রধানত বন্য মহিষের বাসভূমি। বামন মহিষ নয়, অতিকায় মহিষাসুর কেপ-বাফেলোর ভয়াবহ উপস্থিতি অরণ্যকে করে তুলেছে বিপজ্জনক। অ্যাংকোলে নিগ্রোদের ভাষায় পূর্বোক্ত অতিকায় মহিষের নাম জোবি। স্থানীয় মানুষ অর্থাৎ অ্যাংকোলে জাতির নিগ্রোরা খুব লম্বা-চওড়া নয়–বেঁটেখাটো, রোগা ও অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির এই মানুষগুলোকে দেখলে অপরিচিত বিদেশির পক্ষে ধারণা করা সম্ভব নয় যে, প্রয়োজন হলে ওই ছোটোখাটো মানুষগুলো কতখানি দুঃসাহসের পরিচয় দিতে পারে। আফ্রিকার অন্যান্য স্থানে নিগ্রোরা ফাঁদ পেতে অথবা মহিষের চলার পথে গর্ত খুঁড়ে মহিষ-শিকারের চেষ্টা করে, কিন্তু অ্যাংকোলে-শিকারি অমন নিরাপদ পন্থায় শিকারকে ঘায়েল করার পক্ষপাতী নয়। কোন বিস্তৃত যুগে অ্যাংকোলে জাতির পূর্বপুরুষ আবিষ্কার করেছিল মহিষ-চরিত্রের অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য–মরা মানুষকে মহিষ আঘাত করে না। তারপর থেকেই যুগযুগান্তর ধরে অ্যাংকোলে শিকারিরা যে পদ্ধতিতে মহিষ শিকার করে থাকে, সেই বিপজ্জনক পদ্ধতির অনুসরণ করার সাহস অন্য কোনো জাতিরই নেই। কম্যান্ডার গণ্ডি একবার অ্যাংকোলে জাতির মহিষ-শিকারের কায়দা দেখেছিলেন। সমস্ত ঘটনাটা স্বচক্ষে দেখার পর তিনি বলেছিলেন, সাদা কিংবা কালো চামড়ার অন্য কোনো জাতির শিকারি ওইভাবে অপঘাত মৃত্যুর ঝুঁকি নিতে সাহস করবে না। নিজের সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে কম্যান্ডার সাহেব জানিয়েছিলেন, পৃথিবীর সেরা লক্ষ্যভেদী শিকারি যদি কাছেই রাইফেল বাগিয়ে বসে থাকে, তাহলেও অ্যাংকোলে জাতির পদ্ধতিতে মহিষ শিকার করতে তিনি রাজি নন।