দানব বুঝল ক্যাথার্লি তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন, দন্তবিকাশ করে সে ইংরেজিতে জানিয়ে দিলে তার নাম টোনিও।
ক্যাথার্লি খুশি হলেন–টোনিও কেবল অসাধারণ দেহের অধিকারী নয়, তার মস্তিষ্কও যথেষ্ট উন্নত। মোটবাহকদের দলের মধ্যে টোনিও হচ্ছে একমাত্র লোক যে ইংরেজি ভাষা বুঝতে পারে এবং বলতে পারে।
কিন্তু সবচেয়ে যে বস্তুটি ক্যাথার্লির বিস্মিত দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছিল সেটি হচ্ছে টোনিওর হাতের বর্শা। সাধারণ বর্শার মতো কাষ্ঠদণ্ডের সঙ্গে ধারালো লোহার ফলা আটকে এই অস্ত্রটি তৈরি করা হয়নি–একটি সরল লৌহদণ্ডকে বর্শার মতো ব্যবহার করেছিল টোনিও।
ওই লোহার ডান্ডার মুখটা ছিল সরু আর ধারালো। গুরুভার অস্ত্রটিকে অতি সহজেই বহু দূরে নিক্ষেপ করতে পারত টোনিও এবং তার নিশানাও ছিল পাকা, সহজে সে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না।
এমন একটি মনুষ্য-রত্ন পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন ক্যাথার্লি, তাঁর প্রধান পথপ্রদর্শকের পদে বহাল হল টোনিও….
কয়েকদিন পরেই ঘটল এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা।
টোনিওকে সঙ্গে নিয়ে ক্যাথার্লি গিয়েছিলেন পাহাড়ের দিকে শিকারের সন্ধানে। তাঁবুতে যে কয়জন মোটবাহক ছিল তারা মাছ ধরবার জন্য যাত্রা করেছিল নদীর দিকে। সন্ধ্যার সময়ে ক্যাথার্লি টোনিওকে নিয়ে তাঁবুতে ফিরে দেখলেন তাঁবু শূন্য জনপ্রাণীও সেখানে উপস্থিত নেই।
শিকারি প্রথমে বিশেষ চিন্তিত হননি। কিন্তু ঘড়িতে যখন নয়টা বাজল তখন তিনি বিচলিত হয়ে উঠলেন। আফ্রিকার জঙ্গলে রাত্রি ন-টা পর্যন্ত কেউ তাঁবুর বাইরে থাকে না–অন্ধকারের অন্তরালে শ্বাপদসংকুল অরণ্য তখন মৃত্যুর বিচরণভূমি…
অবশেষে তাঁবুর কাছে যে অগ্নিকুণ্ড জ্বলছিল তারই আলোতে দেখা গেল লোকগুলি ফিরে আসছে।
আসছে বটে তবে স্বাভাবিকভাবে নয়।
মাটির ওপর দিয়ে হেঁটে আসছে তিনটি লোক। চতুর্থ ব্যক্তিকে গাছের ডাল দিয়ে তৈরি একটা বিছানার ওপর শুইয়ে তার তিন সঙ্গী ওই শয্যাটিকে বহন করছে।
কাষ্ঠনির্মিত ওই বিছানা তারা নামিয়ে রাখল ক্যাথার্লির সম্মুখে। শয্যার দিকে দৃষ্টিপাত করে চমকে উঠলেন ক্যাথার্লি
হাড়গোড়ভাঙা অবস্থায় যে রক্তাক্ত মাংসপিণ্ডটা কাঠের বিছানার ভিতর পড়ে আছে তার সঙ্গে মনুষ্যদেহের কোনো সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল! ক্যাথার্লির মনে হল একটা গুরুভার বস্তুর নীচে মানুষটাকে পিষে ফেলা হয়েছে!
মডিদের ভাষা জানতেন না ক্যাথার্লি। টোনিও সঙ্গীদের কাছে সমস্ত ঘটনা শুনল, তারপর কম্পিতকণ্ঠে ইংরেজি ভাষায় যে-কাহিনিটি সে পরিবেশন করল তা হচ্ছে এই
নদী থেকে মাছ ধরে মোটবাহকেরা ফিরে আসছিল। হঠাৎ একটা কেপ-বাফেলোর সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ হয়ে যায়। মহিষটা খুব ধীরে ধীরে তাদের দিকে এগিয়ে আসে। ওই সময়ে যদি তারা চুপচাপ সরে পড়ত তাহলে বোধ হয় কোনো দুর্ঘটনা ঘটত না। মহিষ কাছে এসে লোকগুলিকে পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করছিল। খুব সম্ভব কাছাকাছি এসে কৌতূহল নিবৃত্ত করে সে আবার প্রস্থান করত–বিনা কারণে সাধারণত কেপ-বাফেলো মানুষকে আক্রমণ করে না। দুর্ভাগ্যবশত মডিদের মধ্যে একজন মহিষটাকে লক্ষ করে বর্শা ছুড়ল। লোকটির নিক্ষিপ্ত অস্ত্র লক্ষ্য ভেদ করল বটে কিন্তু মহিষ একটুও কাবু হল না–মডিদের মাছ-মারা বর্শার খোঁচায় ওই দুর্দান্ত জানোয়ারের কী হবে!
লাঙ্গি নামক যে-যুবকটি বর্শা নিক্ষেপ করেছিল আহত মহিষ তার দিকেই তেড়ে এল।
দলের সবাই ছুটে গাছে উঠে পড়ল, কিন্তু লাঙ্গি পালাতে পারল না ক্ষিপ্ত মহিষ শিং-এর আঘাতে তার পেট চিরে ফেলল। রক্তাক্ত ও বিদীর্ণ উদর নিয়ে ধরাশায়ী হল লাঙ্গি।
মহিষের ক্রোধ তবু শান্ত হল না–সে ঝাঁপিয়ে পড়ল শত্রুর দেহের ওপর!
বিপুলবপুমহিষের পায়ের তলায় চূর্ণ হয়ে গেল হতভাগ্যের অস্থিপঞ্জর। অনেকক্ষণ ধরে অভাগার দেহের ওপর চলল মহিষাসুরের তাণ্ডবনৃত্য–অবশেষে ওই দানব অদৃশ্য হল অরণ্যের অন্তরালে…
গাছের ওপর যারা ছিল তারা অনেকক্ষণ নীচে নামতে সাহস করেনি। মহিষের প্রস্থানের পর প্রায় তিন ঘণ্টা পরে গাছ থেকে নেমে এল তিনটি ভয়ার্ত মানুষ এবং গাছের ডাল কেটে একটা বিছানা তৈরি করে মৃত সঙ্গীর দেহটাকে সেই কাষ্ঠনির্মিত শয্যায় শুইয়ে দিলে। তারপর সেই অপরূপ শবাধার বহন করে তারা তাবুতে ফিরে আসে..
পরদিন সকালে গুলিভরা রাইফেল হাতে ক্যাথার্লি ওই খুনি মহিষটার অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন। নিহত যুবকের বর্শার আঘাতে আহত হয়েছিল মহিষ–ক্ষতস্থান থেকে নিঃসৃত রক্তের চিহ্ন অনুসরণ করে এগিয়ে চললেন শ্বেতাঙ্গ শিকারি, তাঁর সঙ্গে চলল টোনিও এবং আরও দুজন মডি যুবক।
রক্তের চিহ্ন অনুসরণ করতে করতে নদীর ধারে এসে সকলে দেখল একটা মস্ত বাঁশবনের শেষে ঘন পাপিরাস ঘাসের মধ্যে অদৃশ্য হয়েছে রক্তরেখা–
অর্থাৎ ওই ঘাসঝোপের ভিতর আশ্রয় গ্রহণ করেছে মহিষ।
সকলেই বুঝল ওই ঘন ঘাসঝোপের ভিতর পদার্পণ করলে পৈতৃক প্রাণটিকে ওখানেই রেখে আসতে হবে। ক্যাথার্লি সাহসী শিকারি, কিন্তু তিনি শিকার করতে এসেছিলেন, আত্মহত্যা করতে আসেননি–
বাঁশবনের সামনে ঝোপের মুখোমুখি দাঁড়ালেন শিকারি, তাঁর আদেশে টোনিও এবং তার দুই সঙ্গী পাপিরাস ঝোপে আগুন লাগিয়ে দিলে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল, ঝোপটাকে ঘিরে নেচে উঠল লেলিহান অগ্নিশিখা…।