অটোর প্রস্তাবে সম্মত হল মাইক।
একদিন খুব ভোরে ঘন জঙ্গল ভেদ করে জার্মান ও আমেরিকানদের মিলিত বাহিনী নিকটবর্তী নিগ্রো পল্লিতে হানা দিল। এমন অতর্কিত আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না গ্রামবাসী।
রাইফেলের ঘন ঘন গর্জন ও হাতবোমার প্রচণ্ড বিস্ফোরণ আতঙ্কের সঞ্চার করল নিগ্রো পল্লির বুকে। ভয়ার্ত নরনারী গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে আশ্রয় নিল শ্বাপদসংকুল অরণ্যের অন্তঃপুরে।
শ্বেতাঙ্গদের মিলিত বাহিনী প্রবেশ করল নির্জন গ্রামের মধ্যে।
দু-দিন পরেই সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে শ্বেতাঙ্গদের সামনে এসে দাঁড়াল ম্যাঙ্গবেটুদের কয়েকজন প্রতিনিধি–তারা শান্তিতে বাস করতে চায়, লড়াই করার আগ্রহ তাদের আর নেই।
শ্বেতাঙ্গরা সম্মত হল। ম্যাঙ্গবেটুদের গ্রামের মধ্যে নিগ্রোদের পাশাপাশি বাস করতে লাগল জার্মান আর আমেরিকান সৈন্যদল! শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের জ্বলন্ত নিদর্শন।
কয়েকদিন পরে এই নাটকীয় বন্ধুত্বের রঙ্গমঞ্চে নেমে এল সমাপ্তির যবনিকা। ম্যাঙ্গবেটুদের গ্রামের কাছে নদীর বুকে আবির্ভূত হল একটি আমেরিকান সী-প্লেন বা উভচর বিমান।
মার্কিন পাইলট জার্মান এবং আমেরিকানদের শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান দেখে বিস্মিত হয়েছিল। মাইকের অনুরোধে বিমানচালক জার্মানদের নিরাপদ অঞ্চলে পৌঁছে দিতে সম্মত হল। স্প্যানিশ গায়নার সীমান্তে একটি নদীর ধারে দাঁড়িয়ে দুই পক্ষ পরস্পরের কাছে বিদায় গ্রহণ করলে। বিদায়ের আগে মাইকের হাত চেপে ধরেছিল অটো গ্যটমেয়ার–ঘটনাচক্রে দুই শত্রুর মধ্যে গড়ে উঠেছিল বন্ধুত্বের বন্ধন, ভাগ্য তাদের সেই বন্ধুত্ব যাচাই করে নিয়েছিল অগ্নিপরীক্ষার ভিতর দিয়ে।
বিমানযোগে তিন বন্ধু নিরাপদে ফিরে এল মিত্রপক্ষের আস্তানায়। অটো গ্যটমেয়ার এবং অন্যান্য জার্মানদের সঙ্গে আর কোনোদিন তাদের সাক্ষাৎ হয়নি।
[ফাল্গুন ১৩৭৬]
অসুর বনাম মহিষাসুর
না না, পুরাণে বর্ণিত মহিষাসুরের কাহিনি আজ লিখতে বসিনি, আমি যে জীবটির কথা বলছি সে হচ্ছে আফ্রিকা বনরাজ্যের জীবন্ত বিভীষিকা
নাম তার কেপ-বাফেলো। আফ্রিকার মহিষাসুর!
বন্য মহিষ মাত্রেই হিংস্র ও উগ্র, এমনকী গৃহপালিত মহিষকেও নিতান্ত শান্তশিষ্ট জানোয়ার বলা চলে না। কিন্তু আফ্রিকার কেপ-বাফেলোর মতো এমন ভয়ানক জানোয়ার পৃথিবীর অন্য কোনো অঞ্চলে মহিষগোষ্ঠীর মধ্যে দেখা যায় না।
মহিষ-পরিবারের অন্তর্গত সব জন্তুর প্রধান অস্ত্র শিং এবং খুর। কেপ-বাফেলো ওই দুই মহাস্ত্রে বঞ্চিত নয়, উপরন্তু শিরস্ত্রাণধারী যোদ্ধার মতো তার মাথার উপর থাকে কঠিন হাড়ের স্থূল আবরণ (ইংরেজিতে যাকে বলে Boss of the Horns)।
অস্থিময় এই কঠিন আবরণ ভেদ করে শ্বাপদের নখ দন্ত বা রাইফেলের গুপ্ত বুলেট মহিষাসুরের মস্তকে ক্ষতচিহ্ন সৃষ্টি করতে পারে না।
নিগ্রো শিকারিরা অনেক সময় বর্শা হাতে মহিষকে আক্রমণ করে। অনেকগুলি বর্শার আঘাতে জর্জরিত হয়ে প্রাণত্যাগ করার আগে মহিষ তার শিং ও খুরের সদ্ব্যবহার করতে থাকে বিদ্যুৎবেগে অবশেষে এই ধরনের বন্য নাটকের উপসংহারে দেখা যায় নিহত মহিষের আশেপাশে লম্বমান হয়ে পড়ে আছে কয়েকটি হত ও আহত নিগ্রো শিকারির রক্তাক্ত দেহ।
এই ভয়ানক জন্তুকে হত্যা করার একমাত্র উপযুক্ত অস্ত্র হচ্ছে শক্তিশালী রাইফেল। তবে রাইফেলের অগ্নিবৃষ্টিও সবসময় কেপ-বাফেলোকে জব্দ করতে পারে না–আফ্রিকার অরণ্যে মহিষের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছে বহু শ্বেতাঙ্গ শিকারি!
এমন দুর্দান্ত জানোয়ারকে টোনিও নামক নিগ্রো যুবকটি জব্দ করেছিল একখানা বর্শার সাহায্যে!
হ্যাঁ, বন্দুক নয়, রাইফেল নয়, এমনকী মহিষ বা হাতি শিকারের উপযুক্ত দীর্ঘ ফলকবিশিষ্ট বল্লমও তার হাতে ছিল না শুধুমাত্র একটি মাছমারা বর্শার সাহায্যে ক্ষিপ্ত মহিষের আক্রমণ রোধ করেছিল টোনিও নামধারী নিগ্রো যুবক!
কথাটা নিতান্ত অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে–তাই নয় কি?
নিম্নলিখিত কাহিনিটি পড়লেই বোঝা যাবে সত্য ঘটনার চেহারা অনেক সময় গল্পের চেয়ে আশ্চর্য, গল্পের চেয়ে ভয়ংকর…।
সুদান অঞ্চলের পূর্বদিকে অবস্থিত পার্বত্য অঞ্চলে হানা দিয়েছিলেন একজন শ্বেতাঙ্গ শিকারি–নাম তার রে ক্যাথার্লি। শিকারির ভাগ্য খারাপ, তার নিগ্রো পথপ্রদর্শক হঠাৎ সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা পড়ল। জিনিসপত্র বহন করার জন্য যে লোকগুলিকে ক্যাথার্লি নিযুক্ত করেছিলেন তারা ছোঁয়াচে অসুখের ভয়ে তল্পিতল্পা ফেলে পালিয়ে গেল।
ক্যাথার্লি বিপদে পড়লেন। শিকারের সরঞ্জামগুলি বহন করার জন্য লোকজন দরকার কিন্তু এই গভীর অরণ্যে তেমন লোক কোথায়? নিরুপায় ক্যাথার্লি শেষ পর্যন্ত মডি জাতীয় নিগ্রোদের সাহায্য নিতে বাধ্য হলেন। মডিরা মৎস্যজীবী অর্থাৎ জেলে, মাছ ধরা তাদের পেশা শিকার-টিকার তারা বোঝে না কিন্তু টাকার মূল্য খুব ভালোভাবেই বুঝতে শিখেছে। টাকার লোভে কয়েকজন মডি জাতীয় ধীবর ক্যাথার্লির মোট বহন করতে রাজি হল।
মডিদের দলের মধ্যে একটি যুবকের দিকে নজর পড়তেই চমকে উঠলেন ক্যাথার্লি ছয় ফুটের উপর লম্বা ওই দীর্ঘকায় মানুষটির প্রশস্ত স্কন্ধ ও পেশিবহুল দেহ যেন অফুরন্ত শক্তির আধার!
শিকারির মনে হল মানবের ছদ্মবেশে তাঁর সম্মুখে আবির্ভূত হয়েছে এক কৃষ্ণকায় দানব!