নিগ্রো যোদ্ধারা পিছিয়ে গেল। অন্ধকার অরণ্যের ভিতর তাদের দেহগুলো শ্বেতাঙ্গদের চোখে পড়ল না, কিন্তু দ্রুত ধাবমান পদশব্দ তাদের জানিয়ে দিলে শত্রু এখন প্রাণ নিয়ে সরে পড়ছে।
আহত জার্মান সৈন্যের দেহটাকে ধরাধরি করে তারা একটা ঘরের ভিতর নিয়ে এল। বনামিয়েরের পায়ের হাড় ভেঙে গিয়েছিল, তার ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগিয়ে বেঁধে দেওয়া হল। বনামিয়ের তখন দারুণ যাতনায় আর্তনাদ করছে, তাকে একটা মরফিয়া ইঞ্জেকশন দিতেই সে ঘুমিয়ে পড়ল–অন্তত কয়েক ঘণ্টার জন্য আঘাতের যন্ত্রণা থেকে সে মুক্তি পেল।
এক সপ্তাহ পরের কথা। রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে স্টার্ন মাইক।
হঠাৎ পায়ের ওপর সে অনুভব করলে তীব্র দংশন!
অস্ফুট স্বরে আফ্রিকার যাবতীয় কীটপতঙ্গকে অভিশাপ দিতে দিতে মাইক তার আহত পায়ের শুশ্রূষা করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল আর সঙ্গেসঙ্গে সে বুঝতে পারল তার হাতের ওপর উঠে পড়েছে অনেকগুলো পতঙ্গ জাতীয় জীব!
মাইক অনুভব করলে তার দুই পায়ের উপরেই কামড় বসাচ্ছে অনেকগুলো পোকা–কিছুক্ষণের মধ্যেই তার হাতের পোকাগুলোও তাকে কামড়াতে লাগল।
তাড়াতাড়ি রাইফেলের বাঁটের ওপর হাতটাকে সজোরে ঘর্ষণ করে মাইক তার হাতটাকে পোকার কবল থেকে মুক্ত করে নিল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিল চাঁদ।
ম্লান জ্যোৎস্নার আলোকধারার মধ্যে মাইকের দৃষ্টিপথে ভেসে উঠল এক অদ্ভুত দৃশ্য!
বনের ভিতর থেকে ফাঁকা মাঠের ওপর বেরিয়ে এসেছে একদল পিঁপড়ে! সেই বিপুল পিপীলিকা বাহিনীর সংখ্যা অনুমান করা অসম্ভব কারণ মাইকের সামনে যে পিঁপড়ের সারিটা এগিয়ে এসেছে তার পিছন দিকটা এখনও অদৃশ্য রয়েছে অরণ্যের অন্তরালে।
কয়েকটা অগ্রবর্তী দলছাড়া পিঁপড়ে ইতিমধ্যেই তার পায়ের ওপর উঠে কামড় বসিয়েছে। মাইকের প্রায় দশ গজ দূরে এসে পড়েছে আসল দলটা!
মাইক তাদের মিলিটারি ব্যারাকের আস্তানা লক্ষ করে ছুটল। মাঝে মাঝে নীচু হয়ে সে পা থেকে পিঁপড়েগুলোকে ছাড়িয়ে নিচ্ছিল। হাত দিয়ে ঘষে ওই মারাত্মক পোকাগুলোর কবল থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব ছিল না–দু-আঙুলে টিপে ধরে মাইক পিঁপড়েগুলোকে টেনে আনছিল তার পায়ের ওপর থেকে!
জীবজগৎ সম্বন্ধে মাইক যদি কিছু খবর রাখত তাহলে সে জানত যে ওই পিঁপড়েগুলো হচ্ছে। আফ্রিকার মারাত্মক ড্রাইভার অ্যান্ট।
এরা যেখান দিয়ে যায় সেখানে পড়ে থাকে অসংখ্য জানোয়ারের কঙ্কাল সিংহ, লেপার্ড প্রভৃতি হিংস্র পশুও এদের মিলিত আক্রমণের মুখে অসহায়ভাবে প্রাণ বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়।
মাইক তার হাতের রাইফেল আওয়াজ করে নিদ্রিত সঙ্গীদের জাগিয়ে দিলে। সকলে ছুটে এসে দেখল, তাদের আস্তানা আর জঙ্গলের মাঝখানে অবস্থিত ফাঁকা জায়গাটার ওপর দিয়ে এগিয়ে আসছে অসংখ্য পিপীলিকার শ্রেণিবদ্ধ বাহিনী!
শ্বেতাঙ্গরা তাড়াতাড়ি পিঁপড়েগুলোর সামনে গ্যাসোলিন ছড়িয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিলে। পিঁপড়েরা নাছোড়বান্দা তারা জ্বলন্ত আগুনের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে আসার চেষ্টা করতে লাগল। সৈন্যরা এবার পিঁপড়ের দলের ওপর গ্যাসোলিন ছড়িয়ে অগ্নিসংযোগ করলে। অনেকগুলো পিঁপড়ে অগ্নিগর্ভে প্রাণ বিসর্জন দিলে অন্যগুলো এদিক-ওদিক সরে গেল।
আচম্বিতে নিকটবর্তী শিবিরগুলোর একটি ঘর থেকে ভেসে এল এক করুণ আর্তনাদ।
সকলেই বুঝল, ওই কণ্ঠস্বরের মালিক হচ্ছে বনামিয়ের।
কারণ সে ছাড়া ওই সময়ে ঘরের মধ্যে কেউ ছিল না। বনামিয়ের যে ঘরে শুয়েছিল সেই ঘরের দিকে সবাই ছুটল…
বীভৎস দৃশ্য!
খাটের ওপর শুয়ে ছটফট করছে আহত বনামিয়ের, তাকে আক্রমণ করেছে পিঁপড়ের দল। জীবন্ত অবস্থায় তার দেহের মাংস ছিঁড়ে খাচ্ছে ওই ভয়ংকর কীটগুলি, ইতিমধ্যেই পিপীলিকার দংশনে তার চক্ষু হয়েছে অন্ধ–চক্ষুহীন রক্তাক্ত অক্ষিকোটরের ভিতর ঘুরে বেড়াচ্ছে শুধু পিঁপড়ে আর পিঁপড়ে!
সকলেই বুঝল, বনামিয়ের আর বাঁচবে না–হিংস্র কীটগুলো তার দেহটাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে, তিলে তিলে নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে করতে তার মৃত্যু হবে ধীরে ধীরে।
সৈনিক মাত্রেই মরতে এবং মারতে প্রস্তুত থাকে, মৃত্যু তাদের কাছে অতি সহজ, অতি স্বাভাবিক। কিন্তু ওই বীভৎস দৃশ্য সহ্য করা যায় না।
লেফটেন্যান্ট অটো কোহনের দিকে তাকাল, কিছু একটা করো! লোকটা এভাবে মরবে?
–কী করব! কিছু করার নেই।
–কিছু করার নেই?
না।
অটো রিভলভারটা বনামিয়েরের মাথা লক্ষ করে তুলে ধরলে।
মাইক মুখ ঘুরিয়ে নিলে অন্যদিকে।
গর্জে উঠল অটোর রিভলভার–গুলি বনামিয়েরের মস্তিষ্ক ভেদ করে তাকে অসহ্য যাতনা থেকে নিষ্কৃতি দিল মুহূর্তের মধ্যে।
সকালের আলো ফুটে ওঠার সঙ্গেসঙ্গে পিপীলিকা বাহিনী সৈন্যদের আস্তানা ছেড়ে জঙ্গলের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল জীবন্ত দুঃস্বপ্নের মতো। সবাই দেখল, পিঁপড়েরা শুধু বনামিয়েরের দেহের মাংস খেয়েই সন্তুষ্ট হয়নি, তার জুতো, রিভলভারের খাপ প্রভৃতি সব কিছুই উদরসাৎ করেছে খুদে রাক্ষসের দল।
বনামিয়েরের মাংসহীন রক্তাক্ত কঙ্কালটাকে সবাই মিলে কবরস্থ করলে।
অটো বললে, এইভাবে আমরা বেশিদিন আত্মরক্ষা করতে পারব না। যদি বাঁচতে হয় তাহলে আমাদের আক্রমণকারী ভূমিকা নিতে হবে।
মাইক বললে, তুমি কী করতে চাও?
অটোর অভিমত হচ্ছে এই যে তারা যদি ম্যাঙ্গবেটু নিগ্রোদের একটি গ্রাম অধিকার করতে পারে তবে স্থানীয় বাসিন্দারা ভীত হয়ে পড়বে, খুব সম্ভব তারা আর লড়াই করতে চাইবে না।