ওই পরিচয়পত্রের দিকে আকৃষ্ট হল কোহন নামক জনৈক জার্মান সৈনিকের দৃষ্টি।
কোহন জিনিসটা দেখতে চাইল। মালা থেকে পরিচয়পত্রটি খুলে মাইক সেটাকে কোহনের হাতে দিল। কোহনের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল আর একজন জার্মান নাম তার হহেনস্টিন। সঙ্গীর হাত থেকে পরিচয়পত্র নিয়ে নিবিষ্ট চিত্তে জিনিসটাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল সে, তার দুই চোখে ফুটে উঠল তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষের আভাস!
হহেনস্টিন ক্রুদ্ধস্বরে বললে, আরে, এই লোকটা দেখছি ইহুদি! ওহে কোহন–এই নোংরা শুয়োরটা ইহুদি! ছি! ছি!
(ইহুদিদের প্রতি তীব্র ঘৃণা পোষণ করত জার্মান জাতি। হিটলারের নির্দেশে এই সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও আক্রোশ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল জার্মান জাতির মধ্যে।)
গালাগালি শুনে চুপ করে থাকার মতো সুবোধ ছেলে নয় মাইক স্টার্ন–সে বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল হহেনস্টিনের ওপর!
চোখের পলক ফেলার আগেই শুরু হয়ে গেল মারামারি!
গোলমাল শুনে সেখানে ছুটে এল জার্মান লেফটেন্যান্ট অটো। তার সঙ্গে সঙ্গে এল অন্যান্য জার্মান সৈনিক এবং মাইকের দুই বন্ধু।
মাইককে ছেড়ে দিয়ে অটোর দিকে এগিয়ে এল হহেনস্টিন, স্যার! এই শুয়োরটা ইহুদি! আমি এইমাত্র জেনেছি!
ক্রুদ্ধকণ্ঠে গর্জে উঠল মাইক, হ্যাঁ, আমি ইহুদি তাতে কী হয়েছে?
অটো বিস্মিত স্বরে বললে, তুমি ইহুদি? আশ্চর্য! তোমাকে দেখে তো মনে হয় না যে তুমি ইহুদি!
মাইক রোষরুদ্ধ স্বরে বললে, ইহুদিরা কেমন দেখতে হয়? তারা কি মানুষ নয়? তোমার মতো আমারও দুটো হাত আর দুটো পা আছে।
অটো বললে, তা ঠিক। তবে আমরা শুনেছি ইহুদিরা ভালো লোক নয়।
ভুল শুনেছ, জবাব দিল ম্যাক কার্থি, শয়তান হিটলার তোমাদের যা বুঝিয়েছে তোমরা তাই বুঝেছ। কিন্তু অটো, তোমার তো বেশ বুদ্ধি আছে–তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ যে,ওই হিটলারটা হচ্ছে পয়লা নম্বরের মিথ্যুক!
এক মুহূর্তে সমস্ত পরিবেশ হয়ে উঠল ভয়ংকর।
জার্মানরা এসে দাঁড়াল অটোর পাশে, তাদের চোখের দৃষ্টি থেকে মুছে গেছে বন্ধুত্বের স্বাক্ষর, চোয়ালের রেখায় রেখায় পাথরের কাঠিন্য।
একজন জার্মান গম্ভীর স্বরে বললে, লেফটেন্যান্ট! হুকুম দাও!
মাইকের দুই পাশে ছড়িয়ে পড়ল দুই বন্ধু।
ম্যাক কার্থি খাপ থেকে পিস্তল টেনে নিল।
রাইফেলের বাঁটের ওপর চেপে বসেছে জার্মান সৈনিকের কঠিন মুষ্টি, ট্রিগারের ওপর সরে এসেছে আঙুল—
আবার প্রশ্ন এল জার্মান ভাষায়, কী হুকুম? লেফটেন্যান্ট?
কিন্তু অটো মুর্খ নয়।
শান্তভাবে চারদিকে চোখ বুলিয়ে সে বললে, লড়াই করার মতো উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে বটে, কিন্তু। আমি লড়াই-এর হুকুম দেব না। ইহুদিরাও মানুষ, হহেনস্টিন অন্যায়। করেছে।
লেফটেন্যান্টের আদেশে হহেনস্টিন ক্ষমা চাইতে বাধ্য হল।দুইপক্ষই আবার। অস্ত্র নামিয়ে নিল।
মেঘ সরে গিয়েছে, ঝড় আর উঠবে না।
অটোর ব্যবস্থা অনুযায়ী প্রতি রাত্রে পালা করে একজন পাহারা দেয়। আজ জার্মান সান্ত্রি বনামিয়েরের পালা! বনামিয়ের তার হাতঘড়ির দিকে তাকাল–এগারোটা বেজে তিরিশ মিনিট হয়েছে।
একটা গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সে আরাম করতে লাগল…
হঠাৎ কার পায়ের তলায় সশব্দে ভেঙে গেল একটা শুকনো গাছের ডাল। চমকে উঠল জার্মান প্রহরী বনামিয়ের।
আবার সেই শব্দ! শুকনো গাছের ডালগুলো ভেঙে যাচ্ছে কাদের পায়ের তলায়?
দুই চোখ পাকিয়ে শব্দ লক্ষ করে দৃষ্টি সঞ্চালিত করতেই, বনামিয়ের দেখল তার চারপাশে অন্ধকারের বুকে ভেসে উঠেছে অনেকগুলো চলমান মনুষ্যদেহ নিগ্রো যোদ্ধার দল!
দারুণ আতঙ্কে জার্মান প্রহরীর বুদ্ধিভ্রংশ হল, রাইফেলটাকে শক্ত মুঠিতে চেপে ধরে সে দাঁড়িয়ে রইল নিশ্চল পাথরের মূর্তির মতো… কিছুক্ষণ পরে ভয়ের ধাক্কাটা কাটিয়ে নিয়ে বনামিয়ের তার কর্তব্য স্থির করে ফেলল। খুব ধীরে ধীরে সে মাটির উপর বসে পড়ল–অন্ধকারের মধ্যে তার দেহটা এখনও নিগ্রোদের দৃষ্টিগোচর হয়নি।
মাটি থেকে একটা শুকনো গাছের ডাল তুলে নিয়ে বনামিয়ের দূরে ছুঁড়ে দিল। ডালটা সশব্দে মাটির ওপর পড়ল–সঙ্গেসঙ্গে শব্দ লক্ষ করে ছুটে এল চারটে ভূতুড়ে ছায়া গাছের আড়াল থেকে!
বনামিয়ের গুলি ছুড়ল। তারপর পিছন ফিরে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল আস্তানার দিকে। তার ধাবমান দেহের এপাশ দিয়ে ওপাশ দিয়ে সাঁ সাঁ করে উড়ে গেল অনেকগুলো বর্শা। বনামিয়ের একটা ঘরের খুব কাছাকাছি এসে পড়ল আর একটু গেলেই সে দেয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে আত্মরক্ষা করতে পারবে। কিন্তু বেচারার উদ্দেশ্য সফল হল না, তার বাম ঊরুর ওপর বিদ্ধ হল একটি বর্শা বনামিয়ের মাটির ওপর ছিটকে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল।
ইতিমধ্যে রাইফেলের শব্দে আমেরিকান আর জার্মান সৈন্যদের ঘুম গেছে ভেঙে, চটপট রাইফেল নিয়ে তারা ছুটে এসেছে অকুস্থলে নিকটবর্তী অরণ্যের ভিতর দিয়ে ঝোপঝাড় ভেদ করে আঙুলের চাপে চাপে রাইফেলের মুখ থেকে ছিটকে পড়েছে তপ্ত বুলেট বৃষ্টিধারার মতো!
সেই দারুণ অগ্নিবৃষ্টির মুখে লুটিয়ে পড়ল কয়েকজন কৃষ্ণাঙ্গ যোদ্ধা, বাকি সবাই তাড়াতাড়ি জঙ্গলের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। শ্বেতাঙ্গরা এবার অদৃশ্য শত্রুদের লক্ষ করে হাতবোমা ছুড়ল ঘন জঙ্গল আর ঝোপঝাড়ের ভিতর প্রচণ্ড শব্দে ফাটাতে লাগল বোমাগুলো।