সন্ধির একটি বিশেষ শর্ত ছিল এই যে, কোনো কারণে যদি অবস্থার পরিবর্তন ঘটে, তাহলেও একপক্ষ অপর পক্ষকে যুদ্ধবন্দি হিসাবে গণ্য করতে পারবে না।
শর্তটা উভয়পক্ষেরই মনঃপূত হয়েছিল।
সাময়িকভাবে নিজেদের শত্রুতা ভুলে দুই পক্ষ এইবার মিলিতভাবে নিগ্রোদের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত হতে লাগল।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। সন্ধ্যার আগেই শুরু হল আক্রমণ। নয়টি রাইফেল ঘনঘন গর্জন করে অনেকগুলো কৃষ্ণাঙ্গ যোদ্ধার হত ও আহত দেহ শুইয়ে দিল মাটির ওপর।
নিগ্রোরা পিছিয়ে গেল… আবার আক্রমণ করলে… শ্বেতাঙ্গদের আস্তানার উপর এসে পড়ল ঝাঁকে ঝাঁকে বল্লম… রাইফেলের অগ্নিবৃষ্টিও বুঝি আর নিগ্রোদের ঠেকিয়ে রাখতে পারে না…
শ্বেতাঙ্গরা এইবার গ্রেনেড (হাতবোমা) ব্যবহার করলে। নিগ্রো যোদ্ধাদের উপর ছিটকে পড়ল কয়েকটা হাতবোমা, আগুনের ঝলকে ঝলকে ধূম এবং মৃত্যু পরিবেশিত হল চতুর্দিকে, হতাহত সঙ্গীদের ফেলে সভয়ে পলায়ন করলে বর্শাধারী কালো মানুষগুলো বিজ্ঞানের মহিমায় স্তব্ধ হয়ে গেল অরণ্যের বন্য বিক্রম!
কেটে গেল কয়েকটি দিন আর কয়েকটি হাত। এর মধ্যে আবার আক্রমণ করেছে ম্যাঙ্গবেটু নিগ্রোরা, কিন্তু শ্বেতাঙ্গদের রাইফেলের অগ্নিবৃষ্টির মুখে ব্যর্থ হয়েছে তাদের আক্রমণ। একজন জার্মান সেনা প্রাণ হারিয়েছে বর্শার আঘাতে। চারদিকে হাতবোমার সাহায্যে মাইন পেতে আত্মরক্ষা করতে লাগল জার্মান ও আমেরিকান সৈন্যরা।
সেদিন প্রকাশ্যে দিবালোকে দুজন নিগ্রো জঙ্গলের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে ফাঁকা জায়গায় দাঁড়াল। তাদের মধ্যে একজনের অঙ্গসজ্জা দেখে শ্বেতাঙ্গরা অনুমান করল লোকটি ম্যাঙ্গবেটুদের মধ্যে প্রভাবশালী সর্দার-শ্রেণির মানুষ; অপর ব্যক্তির একহাতে শিকলে বাঁধা পাঁচটি কুকুর, অন্যহাতে একটা চামড়ার থলি। কুকুরগুলো সাগ্রহে চামড়ার থলিটা বার বার শুঁকছে। সর্দারের হাতে একটা লাঠির আগায় সাদা কাপড় বাঁধা–সন্ধির চিহ্ন সাদা নিশান!
অটো তৎক্ষণাৎ তাদের গুলি করতে চাইল, কিন্তু মাইক বলল, দাঁড়াও, আগে ওদের বক্তব্যটা শুনি। পরে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে।
মাইনের মৃত্যুফাঁদ থেকে যে পথটা মুক্ত, সেই সরু রাস্তাটার দিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করে মাইক ম্যাঙ্গবেটুদের কাছে আসতে ইঙ্গিত করল।
সর্দারের মুখে ফুটল ধূর্ত হাসির রেখা, নিশানটা সজোরে মাটির ওপরে বসিয়ে দিয়ে সঙ্গীর থলি থেকে কয়েকটা রক্তাক্ত মাংসের টুকরো বার করে সে ছুঁড়ে দিল সাদা মানুষদের দিকে। সঙ্গীও শিকলের বাঁধন থেকে কুকুরগুলোকে মুক্তি দিল তৎক্ষণাৎ।
জার্মান ও আমেরিকান সৈন্যরা মাটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শয্যাগ্রহণ করল উপুড় হয়ে। প্রায় সঙ্গেসঙ্গে হাতবোমার তারে ধাবমান কুকুরের পা লাগল। একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ–মুহূর্ত পরেই আরও চারটি বোমা ফাটল ভীষণ শব্দে!
শ্বেতাঙ্গরা সম্মুখে দৃষ্টিপাত করল। কুকুরগুলোর মৃতদেহ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। নিগ্রো দুজন মাইকের নির্দিষ্ট নিরাপদ পথ ধরে সতর্ক চরণে এগিয়ে আসছে।
শ্বেতাঙ্গদের সামনে এসে হোমরাচোমরা গোছের লোকটি তার সঙ্গীকে কথা কইতে নির্দেশ দিল।
ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে নিগ্রোটি জানাল তার সঙ্গে এসেছে মহামান্য মবংগো! মবংগো ওই গ্রামের জাদুকর। তার ক্ষমতা অসীম। মবংগো বলছে, সাদা মানুষরা যদি এই ঘাঁটি এখনই ছেড়ে দিতে রাজি থাকে, তাহলে তাদের নিরাপদে যেতে দেওয়া হবে। কথা না-শুনলে মবংগোর আদেশে ম্যাঙ্গবেটুরা সাদা মানুষদের হত্যা করবে। মাটির ওপর ফেটে যাওয়া জিনিসগুলোকে তারা ভয় করে না, ওগুলোকে ফাঁকি দেওয়ার রাস্তা তারা দেখে নিয়েছে।
অটো মাইকের দিকে চাইল, কী বল? ওদের প্রস্তাবে রাজি হব?
অসম্ভব, মাইক বলল, ওরা সুযোগ পেলেই আমাদের খুন করবে। বরং এখানে দাঁড়িয়ে আমরা লড়তে পারব। ঘাঁটি ছেড়ে গেলে আমাদের মৃত্যু নিশ্চিত।
অটো মাইকের যুক্তি মেনে নিল। তারপর নিগ্রো দোভাষীর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কর্তাকে বলো আমরা এই জায়গাতেই থাকব। কোথাও যাব না।
দোভাষীর মুখ থেকে শ্বেতাঙ্গদের বক্তব্য শুনে দারুণ ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল জাদুকর মবংগো। সে থুথু ছিটিয়ে দিল অটোর মুখে!
মুহূর্তের মধ্যে খাপ থেকে পিস্তল টেনে নিয়ে পর পর দু-বার গুলি ছুড়ল অটো। গুলি লাগল জাদুকরের পেটে। সঙ্গীটি দারুণ আতঙ্কে হাঁ করে চেয়ে রইল সাদা মানুষদের দিকে। তার দিকে তাকিয়ে হিংস্রভাবে দাঁত বার করে গর্জে উঠল অটো, যাও, এই হতভাগাকে জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে যাও।
মরণাপন্ন জাদুকরকে নিয়ে নিগ্রোটি জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল…
কয়েকটা দিন নিরুপদ্রবে কাটল। কিন্তু শ্বেতাঙ্গরা তাদের পাহারা শিথিল করল না। তারা জানত ম্যাঙ্গবেটুরা সুযোগ খুঁজছে, একটু অসতর্ক হলে আর রক্ষা নেই। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জার্মান আর আমেরিকানরা তাদের শত্রুতা ভুলে গেল। অলস মধ্যাহ্নে তারা তাস খেলে মুখোমুখি বসে, রাতের অন্ধকারে পাহারা দেয় বিনিদ্র নেত্রে।
ছোটোখাটো তুচ্ছ বিষয় থেকে অনেক সময় হয় মারাত্মক বিপদের সূত্রপাত ।
মাইক যদি জানত তার পরিচয়পত্রটি অত বড়ো বিপদ ডেকে আনবে, তাহলে বোধ হয় সে যত্ন করে ওই জিনিসটিকে মালার সঙ্গে আটকে বুকের ওপর ঝুলিয়ে রাখত না।