সিংহ-মানুষের মতো চিতা-মানুষও একই উপায়ে নরহত্যা করে। তফাত শুধু এই যে লেপার্ডম্যান বা চিতা-মানুষ সিংহের ছদ্ম আবরণের পরিবর্তে চিতাবাঘের ছদ্মবেশ ধারণ করে।
আফ্রিকাবাসীদের বিশ্বাস এইসব নকল সিংহ-মানুষ বা চিতা-মানুষ ছাড়া এমন লোক আছে যারা ইচ্ছা করলেই নিজের নরদেহকে পরিবর্তিত করে হিংস্র শ্বাপদের রূপ ধারণ করতে পারে।
আফ্রিকার স্থানীয় মানুষের এইরূপ বিশ্বাস-অবিশ্বাসকে কিছু কিছু ঘটনা দিয়ে বিচার করে হয়তো একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব ছিল, কিন্তু আগেই বলেছি, নরখাদক শ্বাপদ, লৌকিক অপরাধী এবং অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী জাদুকরদের গোলকধাঁধার জটিলতা ভেদ করে প্রকৃত রহস্যের সমাধান করা খুব কঠিন কাজ। প্রসঙ্গত আর একটি ঘটনার উল্লেখ করছি।
উল্লিখিত কাহিনিটি বলেছেন ব্রিটিশ সরকারের একজন ইংরেজ কর্মচারী, নাম তার এইচ ডবলিউ টেলর।
টেলর সাহেবের লিখিত বিবরণী থেকে সংক্ষেপে কাহিনিটি বলছি :
ইথিওপিয়ান সোমালিল্যান্ডের সীমানায় সরকারের কার্যে নিযুক্ত হয়েছিলেন টেলর সাহেব। রাজনৈতিক কারণে পূর্বোক্ত অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে টহল দিয়ে তিনি পর্যবেক্ষণ কার্য চালাতেন–ওইটি ছিল তার কর্তব্য কর্ম।
বনচারী হিংস্র পশুরা তাদের রাজ্যে মানুষের অনধিকার প্রবেশ বিনা প্রতিবাদে মেনে নিতে রাজি হয়নি তাই গর্জিত রাইফেল আর উদ্যত নখান্তের সংঘর্ষে বনরাজ্যের শান্তিভঙ্গ হয়েছে বারংবার।
টেলর সাহেবের নিশানা ছিল অব্যর্থ; পশুরাজ সিংহের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে বড়ো আনন্দ পেতেন মি. টেলর–তার রাইফেলের গুলি খেয়ে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে স্বর্গের দিকে প্রস্থান করেছিল অনেকগুলো সিংহ।
অন্যান্য হিংস্র জন্তুও তিনি শিকার করেছিলেন কিন্তু বিশেষভাবে তার মন এবং দৃষ্টিকে আকৃষ্ট করেছিল পশুরাজ সিংহ।
টেলর যে অঞ্চলে সরকারের প্রতিনিধি হয়ে এসেছিলেন সেই এলাকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব ছড়িয়ে বাস করছিল এক বৃদ্ধ সিংহ। স্থানীয় নিগ্রোরা তার নাম দিয়েছিল লিবা। লিবা নরখাদক। তবে গৃহপালিত পশুর মাংসেও তার অরুচি ছিল না। স্থানীয় মানুষ তাকে ভয় করত যমের মতো।
জন্তুটার পদচিহ্ন দেখে খুব সহজেই তাকে শনাক্ত করা যেত। লিবা নামক সিংহটির বাঁ-দিকের থাবায় একটা আঙুল ছিল না, খুব সম্ভব কোনো ফাঁদের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার সময়ে ওই আঙুলটাকে সে বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছিল।
নিহত গোরু-বাছুরের কাছে লিবার পায়ের চিহ্ন দেখলে স্থানীয় নিগ্রোরা আতঙ্কে বিহ্বল হয়ে পড়ত। তারা সিংহটাকে কখনো হত্যা করার চেষ্টা করেনি। হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার সঙ্গেসঙ্গে টেলর সাহেবকে খবর দিলে তিনি নিশ্চয়ই রাইফেল হাতে ছুটে আসতেন এবং নিহত শিকারের আশেপাশে লুকিয়ে থেকে লিবাকে শায়েস্তা করার চেষ্টা করতেন।
মৃত পশুর মাংস খাওয়ার জন্য দ্বিতীয়বার অকুস্থলে আবির্ভূত হলেই লিবা পড়ত সাহেবের রাইফেলের মুখে।
কিন্তু নিগ্রোরা কখনো যথাসময়ে হত্যাকাণ্ডের সংবাদ সরবরাহ করত না। টেলর খবর পেতেন অন্তত দুই কি তিন দিন পরে ততক্ষণে লিবা শিকারের মাংস উদরস্থ করে সরে পড়েছে নির্বিবাদে। অনেক চেষ্টা করেও টেলর লিবার সাক্ষাৎ পাননি।
কিন্তু টেলর সাহেব লিবার সংবাদ না-রাখলেও লিবা নিশ্চয়ই সাহেবের খবর রাখত।
তখন বর্ষাকাল। বিশেষ কাজে টেলর তার দল নিয়ে টহল দিতে বেরিয়েছেন। টেলর গন্তব্যস্থলে উপস্থিত হওয়ার আগেই অরণ্যের বুকে উপস্থিত হল রাত্রির নিবিড় অন্ধকার। পরিশ্রান্ত টেলর তবু তাবু ফেলার আদেশ দিলেন না তিনি ভাবছেন কোনোরকমে সামনে আট মাইল পথ অতিক্রম করতে পারলেই তিনি গ্রামের মধ্যে এসে পড়বেন–তার মানসপটে ভেসে উঠেছে কুটিরের মধ্যে অবস্থিত একটি তপ্ত শয্যার লোভনীয় দৃশ্য।
হঠাৎ পিছন থেকে সশস্ত্র আস্কারিদের সর্দার তাকে জানিয়ে দিলে একটা সিংহ তাদের পিছু নিয়েছে। সাহেব ব্যাপারটাকে বিশেষ গুরুত্ব দিলেন না। এখানকার বনে-জঙ্গলে অনেক সিংহ আছে–সিংহকে ভয় করলে আফ্রিকার বনভূমিতে ঘোরাফেরা করা চলে না। কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আট মাইল পথ পাড়ি দেওয়ার উৎসাহ আর রইল না–টেলর তাবু খাটাতে বললেন।
সেই রাতেই টেলরের আস্তানায় হল সিংহের আবির্ভাব। গভীর রাত্রে গোরু আর উটের দল দড়ি ছিঁড়ে বেড়া ভেঙে ছুটোছুটি করতে লাগল কয়েকটা জন্তু আবার বন্ধন মুক্ত হয়ে ছুটল জঙ্গলের দিকে… অরণ্যের অন্ধকার কালো যবনিকা ফেলে তাদের দেহগুলিকে ঢেকে ফেলল কিছুক্ষণের মধ্যে।
টেলর অথবা তার দলের লোকজন কোনো বন্য পশুর অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পারলেন না, কিন্তু অনুমানে বুঝলেন একটু আগেই এখানে হয়েছিল সিংহের আবির্ভাব। গৃহপালিত জন্তুদের এই ধরনের আতঙ্কের একটিই কারণ থাকতে পারে সিংহ!
পশুরাজ অত্যন্ত ধূর্ত। সে এমনভাবে রজ্জবদ্ধ গোরু-বাছুরের কাছে এসে দাঁড়ায় যে মানুষরা সিংহের উপস্থিতি বুঝতে না-পারলেও জন্তুগুলো গায়ের গন্ধে পশুরাজের অস্তিত্ব বুঝতে পারে।
ভয়ে পাগল হয়ে জন্তুগুলো দড়ি ছিঁড়ে বেড়া ভেঙে ছুটোছুটি করতে থাকে এবং মানুষের নিরাপদ সান্নিধ্য ছেড়ে ছুটতে ছুটতে এসে পড়ে বনজঙ্গলের মধ্যে! এই সুযোগেরই অপেক্ষায় সিংহ পছন্দসই একটা মোটাসোটা গোরু অথবা বাছুরকে বধ করে শিকারের মাংসে ক্ষুন্নিবৃত্তি করে। এখানেই সেই ব্যাপার।