তিন বন্ধু ছুটল মেজরের কাছে ব্যাপারটা কী?
মেজর জুভেনাক জানালেন, তাঁরা এই জায়গা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।
তিন বন্ধুর জিজ্ঞাস্য, তাদের কী হবে?
জুভেনাক রূঢ়স্বরে জানিয়ে দিলেন, আমেরিকানদের তিনি ব্যক্তিগতভাবে আসতে বলেননি, অতএব তারা কী করবে-না-করবে সে-বিষয়ে চিন্তা করে মস্তিষ্ককে ঘর্মাক্ত করতে তিনি রাজি নন–তারা যা খুশি তাই করতে পারে।
এই প্রয়োজনীয় তথ্য পরিবেশন করে জুভেনাক সসৈন্যে প্রস্থান করলেন। তিন বন্ধু নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করলে তাদের অবস্থা মোটেই আনন্দজনক নয়।
মাইক বললে, আমরা ফাঁদে পড়েছি। নদীর বিপরীত দিকে ঘাঁটি নিয়েছে জার্মান সৈন্য আর জঙ্গলের ভিতর ওত পেতে বসে আছে নিগ্রোরা। রক্তপিপাসু ফরাসি মেজর আর শান্তিপ্রিয় আমেরিকার মানুষের মধ্যে নিগ্রো যোদ্ধারা তফাত খোঁজার চেষ্টা করবে না সুযোগ পেলেই ওরা আমাদের হত্যা করবে। অতএব আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে, যেকোনো সময়েই নিগ্রোরা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।
ফরাসিদের পরিত্যক্ত শিবিরগুলো পর্যবেক্ষণ করে তারা জানতে পারল যে খাদ্য ও পানীয়ের অভাব তাদের হবে না। প্রচুর পরিমাণে শুকনো খাদ্য জমানো রয়েছে বায়ুশূন্য টিনের পাত্রে।
আর আছে বীয়ার জাতীয় সুরার অসংখ্য বোতল।
অস্ত্রশস্ত্রের অবস্থাও খুব নৈরাশ্যজনক নয়।
কলের কামান প্রভৃতি ভারি অস্ত্র না-থাকলেও রাইফেল ছিল। গুলি ফুরিয়ে যাওয়ার ভয় নেই–অজস্র টোটা রেখে গেছে ফরাসি সৈন্য। তা ছাড়া আছে পিস্তল, রিভলভার ও অনেকগুলো গ্রেনেড বা হাতবোমা।
যে-ঘরটায় খাদ্য ও পানীয় ছিল সেই ঘরে তারা তালা লাগিয়ে দিলে। সন্ধ্যার পর পানাহার শেষ করে তারা আশ্রয় গ্রহণ করলে একটা ঘরের মধ্যে।
বর্তমানে ওই ঘরটাই হল তিন বন্ধুর দুর্গ।
একটা রাত্রি ভালোভাবেই কাটল। কিন্তু পরের দিন সকালেই হানা দিল নিগ্রো যোদ্ধার দল। তিন বন্ধুর রাইফেল সশব্দে অগ্নি-উগার করলে, কয়েকটি নিগ্রোর হত ও আহত দেহ লুটিয়ে পড়ল মাটির ওপর।
নিগ্রোরা পিছিয়ে গেল। একটু পরে ফিরে এসে আহত সঙ্গীদের তুলে নিয়ে আবার আত্মগোপন করল সবুজ অরণ্যের অন্তরালে। মৃত সঙ্গীদের তারা ছুঁড়ে ফেলে দিল নদীর জলে।
গভীর রাত্রে আবার আক্রমণ করলে নিগ্রোরা। সারারাত্রি ধরে বার বার হানা দিল নিগ্রো বাহিনী, ঘরের ভিতর থেকে অনবরত গুলি চালিয়ে আর হাতবোমা ছুঁড়ে অতি কষ্টে তিন বন্ধু তাদের ঠেকিয়ে রাখল।
পূর্বদিকের আকাশে জাগল অস্পষ্ট আলোর আভাস। নিগ্রোরা আবার গা-ঢাকা দিল বনের আড়ালে। এল প্রভাত।
প্রভাতের শীতল বায়ু তপ্ত হয়ে উঠল ধীরে ধীরে, মাথার ওপর জ্বলে উঠল মধ্যাহ্নের প্রখর সূর্য।
একটা ঘরের মধ্যে বড়ো বড়ো টিনের পাত্রে জল জমিয়ে রেখেছিল ফরাসিরা। ওই জলে তিন বন্ধু স্নান করলে, তারপর আহারপর্ব শেষ করে ফেলল চটপট। গতরাত্রে কেউ ঘুমাতে পারেনি। রাত্রি জাগরণ এবং উত্তেজনার ফলে তারা হয়ে পড়েছিল অবসন্ন। মাইককে পাহারায় রেখে হ্যারিস ও ম্যাক কার্থি শয্যা গ্রহণ করলে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল গভীর নিদ্রায়।
ওঠ! ওঠ! তাড়াতাড়ি!
চিৎকার করে উঠল মাইক স্টার্ন।
দুই বন্ধু বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠল, তারপর মাইকের নির্দেশ অনুযায়ী দৃষ্টি সঞ্চালন করতেই তাদের চোখের সামনে ফুটে উঠল এক অপ্রত্যাশিত দৃশ্য।
বাঁকের মুখে নদীর ধারে নোঙর করেছে একটি নৌকা এবং সেই নৌকা থেকে নেমে আসছে দুজন জার্মান সৈনিক!
তিন বন্ধু অবাক হয়ে দেখল একজন জার্মান সৈন্যের হাতে রয়েছে শ্বেত পতাকা! সন্ধির সংকেত!
হতভম্ব হয়ে পড়ল তিন বন্ধু–দুরন্ত জার্মান সৈন্যরা হঠাৎ এমন শান্তিপ্রিয় হয়ে পড়ল কেন, এ-কথাটা তারা বুঝতে পারল না।
মাইক জার্মান ভাষা জানত। সঙ্গীদের ঘরের মধ্যে রেখে সে পিস্তল হাতে এসে দাঁড়াল জার্মানদের সামনে, কিন্তু তার জার্মান ভাষায় কথা বলার প্রয়োজন হল না।
চোস্ত ইংরেজিতে একজন জার্মান আত্মপরিচয় দিল, আমার নাম অটো গ্যটমেয়ার। আমি জার্মান সৈন্যদলের এক লেফটেন্যান্ট।
তারপর অটো যা বললে তার সারমর্ম হচ্ছে এই :
ম্যাঙ্গবেটু জাতীয় নিগ্রোরা এখন আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গদের নির্বিচারে আক্রমণ করছে–জার্মান, ফরাসি, ইংরেজ, আমেরিকান প্রভৃতি শ্বেতাঙ্গ জাতি তাদের শত্রু এবং অবশ্য বধ্য; অতএব জার্মানি এবং আমেরিকা বৃহত্তর পৃথিবীতে পরস্পরের শত্রু হলেও এই মুহূর্তে সেই শত্রুতা ভুলে এই দুটি ছোটো দল যদি এখানে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নিগ্রোদের বিরুদ্ধে রুখে না-দাঁড়ায়, তাহলে খুব শীঘ্রই নিগ্রোদের আক্রমণে উভয়পক্ষই হবে নিশ্চিহ্ন–জার্মান বা আমেরিকানদের মধ্যে একটি লোকও নিগ্রোদের রোষ থেকে রেহাই পাবে না। তাই নিতান্ত সাময়িকভাবে জার্মানিদের পক্ষ থেকে অটো সন্ধির প্রস্তাব এনেছে। তার দলের আরও চারজন সৈন্য জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে, আমেরিকানরা যদি সন্ধি করতে রাজি হয় তাহলে লেফটেন্যান্টের সঙ্গী তাদের নিয়ে আসবে।
মাইক তার বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করে বুঝল যে, জার্মান সেনানায়কের প্রস্তাব মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
সন্ধি হল। লেফটেন্যান্টের সঙ্গী দূর অরণ্যের গোপন স্থান থেকে চারজন জার্মান সেনাকে নিয়ে এল আমেরিকানদের আস্তানায়। আপাতত এই জায়গাটাই উভয়পক্ষের মিলিত শিবির হল।