তবে চোখে না-দেখলেও হন্তারক যে একটি হায়না সেই বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না।
কয়েকদিন পরেই একটি ঘটনায় ২ প্রমাণ হল আমার ধারণা নির্ভুল।
আমার জন্য নির্দিষ্ট বাড়িটা তখনও তৈরি হয়নি। সবেমাত্র নির্মাণকার্য চলছিল। আমি একটা ঘাসের তৈরি কুঁড়েঘরে সাময়িকভাবে আশ্রয় নিয়েছিলাম।
হঠাৎ একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি নিয়ে ঘুম ভেঙে জেগে উঠলাম। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের সংকেত অগ্রাহ্য করে আবার শয্যা গ্রহণ করব কি না ভাবছি, হঠাৎ একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনলাম আমার বিছানার খুব কাছে। বালিশের তলা থেকে টর্চ নিয়ে জ্বেলে দিলাম।
পরক্ষণেই আমার চোখের সামনে তীব্র বৈদ্যুতিক আলোর মধ্যে ভেসে উঠল একটা প্রকাণ্ড হায়নার মূর্তি!
আমি স্তম্ভিত নেত্রে দেখলাম, আমার বিছানা থেকে মাত্র এক গজ দূরে দাঁড়িয়ে আছে। জন্তুটা এত বড়ো হায়না ইতিপূর্বে আমার চোখে পড়েনি!
নিজের অজ্ঞাতসারেই আমার গলা থেকে বেরিয়ে এল এক তীব্র চিৎকার ধ্বনি, একলাফে শয্যা ত্যাগ করে ঘরের কোণ থেকে আমি বন্দুকটা টেনে নিলাম। এমনই দুর্ভাগ্য যে শুতে যাওয়ার আগে বন্দুকে গুলি ভরতে ভুলে গিয়েছিলাম। টেবিলের উপর একটা ছোটো বাক্সে টোটাগুলো রেখেছিলাম, হাত বাড়িয়ে বাক্সটা খুঁজছি, এমন সময়ে হল আর এক নূতন বিপদ! সাঁ করে ছুটে এল একটা দমকা হাওয়ার ঝটকা, আর সেই হাওয়ার ধাক্কা লেগে কুঁড়েঘরের নীচের দিকের ঝাঁপটা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল!
(উগান্ডার যে অঞ্চলে আমি ছিলাম সেখানকার কুটিরগুলোর দরজায় কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। মেঝের সঙ্গে সমান্তরালভাবে উপর-নীচ লাগানো থাকত দুটি ঝপ বা দরজার পাল্লা।)
ঝাঁপের পাল্লাটা বন্ধ হয়ে যেতেই আমি চমকে উঠলাম। অত্যন্ত সঙ্গিন মুহূর্ত–পালানোর পথ বন্ধ দেখে হায়না হয়তো আমাকে এখনই আক্রমণ করবে। ঝপের নীচের অংশটা সে একলাফে টপকে যেতে পারে বটে কিন্তু পলায়নের ওই সহজ পন্থা তার মগজে ঢুকবে কি না। সন্দেহ।
বুনো জানোয়ার যদি নিজেকে কোণঠাসা মনে করে তাহলে সে সামনে যাকে পায় তার ওপরই ঝাঁপিয়ে পড়ে।
জন্তুটার বিরাট দেহের দিকে তাকালাম।
সত্যি, এটা একটা অতিকায় হায়না।
যদি এক গুলিতে জন্তুটাকে শুইয়ে দিতে না-পারি তবে বন্ধ ঘরের মধ্যে হায়নার আক্রমণে, আমার মৃত্যু সুনিশ্চিত। খুব সাবধানে যতদূর সম্ভব আমি বন্দুকে গুলি ভরতে লাগলাম।
হঠাৎ বন্ধ ঘরের মধ্যে হল আর এক চতুষ্পদের আবির্ভাব! আমার বুল-টেরিয়ার শ্যাম বোধ হয় দরজার কাছেই ছিল–নীচের দিকের ঝাঁপটা একলাফে ডিঙিয়ে এসে শ্যাম হায়নাকে আক্রমণ করলে!
শ্যাম সাহসী কুকুর, কিন্তু বোকা নয়।
হায়নার ভয়ংকর দাঁত আর শক্তিশালী চোয়াল সম্বন্ধে সে যথেষ্ট সচেতন–চারপাশে ঘুরে ঘুরে আক্রমণ চালিয়ে শত্রুকে সে বিব্রত করে তুলল, কিন্তু হায়নার ঘাড়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে নিজের জীবন বিপন্ন করলে না।
হায়নার দংশন অতি ভয়ংকর, এক কামড়েই সে শ্যামের মাথার খুলি ভেঙে দিতে পারে। বুদ্ধিমান কুকুর তাকে সেই সুযোগ দিলে না।
ইতিমধ্যে নিজেকে সামলে আমি এক লাথি মেরে দরজার নীচের অংশটা খুলে দিলাম। তৎক্ষণাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে হায়নাটা দূরের ঝোপ লক্ষ করে ছুটল।
আমি ততক্ষণে বন্দুকে গুলি ভরে ফেলছি।
জন্তুটাকে লক্ষ করে গুলি ছুড়লাম। নিশানা ব্যর্থ হল।
হায়নার ধাবমান দেহ অদৃশ্য হয়ে গেল অরণ্যের অন্তরালে।
বেশ কয়েকটা দিন কাটল নির্বিবাদে।
আমরা ভাবলাম খুনি বোধ হয় আমাদের আর বিরক্ত করবে না। কিন্তু কয়েকদিন পরেই আবার শুরু হল হত্যাকাণ্ড।
প্রতি রাত্রেই একটি কি দুটি ভেড়া হায়নার কবলে মারা পড়তে লাগল।
আমার জেদ চেপে গেল, জন্তুটাকে মারতেই হবে।
প্রতিদিন শেষরাতে ভোর হওয়ার একটু আগে আমি সমস্ত অঞ্চলটায় টহল দিতে শুরু করলাম। পরপর আটটি রাত কাটল, অবশেষে নবম রাত্রে আমার চেষ্টা সফল হল।
একটু দূরে অবস্থিত উঁচু জমির তলায় ঝোপের ভিতর, একটা কালো ছায়া যেন স্যাৎ করে সরে গেল!
হয়তো চোখের ভুল।
তবু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। না, ভুল হয়নি
হঠাৎ ঝোপের ওপর উঁচু জমির ওপর আত্মপ্রকাশ করল একটা চতুষ্পদ পশু!
নীলাভ-কৃষ্ণ আকাশের পটভূমিকায় উচ্চ ভূমির ওপর দণ্ডায়মান হায়নার দেহটা খুব স্পষ্ট হয়ে উঠল আমার দৃষ্টিপথে–লক্ষ্য স্থির করে গুলি ছুড়লাম।
গুলি লাগল হায়নার পেটে। দারুণ যাতনায় অস্থির হয়ে জন্তুটা নিজের উদর দংশন করতে লাগল। আবার অগ্নিবৃষ্টি করলে আমার বন্দুক, হায়নার মৃতদেহ উপর থেকে আছড়ে পড়ল নীচের জমিতে গুলি এইবার জন্তুটার মস্তিষ্ক ভেদ করেছে।
মৃত হায়নার কাছে এসে তাকে লক্ষ করতে লাগলাম। বিরাট জানোয়ার। জন্তুটার দেহে কিছু খুঁত আছে।
তার পিছনের একটি পা ভাঙা, অজ্ঞাত কোনো দুর্ঘটনার ফলে তার একটি চক্ষু হয়েছে অন্ধ এবং নাসিকার কিছু অংশ লুপ্ত হয়ে গেছে মুখের ওপর থেকে!
বিদ্যুৎচমকের মতো আমার মনে একটা সন্দেহের ছায়া উঁকি মারল, মুহূর্তের জন্য আমার মানসপটে ভেসে উঠল একটি মৃত মানুষের প্রতিমূর্তি!
কিছুদিন আগে যে নিগ্রো মজুরটি মারা গেছে তার সঙ্গে এই জন্তুটা অদ্ভুত সাদৃশ্য আছে। পূর্বোক্ত মানুষটিরও ছিল একটি পা ভাঙা, একটি চোখ অন্ধ এবং ভূমিশয্যায় শায়িত এই মৃত হায়নার মতো তার মুখের উপরও ছিল না নাসিকার অস্তিত্ব।