প্রায় পঁচিশ গজ যাওয়ার পরে নৌকোর উপর উপবিষ্ট এক জন ইয়াঘো মাঝি তার হাতের দাঁড় তুলে বাঁ দিকে উঁচিয়ে ধরল। সেদিকে লক্ষ্য করে পাবলো দেখল, জলের উপর দুলছে একটা বর্শাদণ্ড!
আর একটু দূরেই নদীর জলে ভাসছে একটা কুৎসিত ও ভয়ংকর মুখ– আনাকোন্ডা।
নৌকো আর সপর্দানেবের মধ্যবর্তী দূরত্ব ছিল আন্দাজ ৩৫ গজ। তিন-তিনটি রাইফেল নৌকোর উপর থেকে সাপের দেহ লক্ষ্য করে অগ্নি-উদ্গার করল। দোদুল্যমান নৌকোর উপর থেকে নিশানা স্থির করা খুব কঠিন। তা ছাড়া সাপটাও স্থির হয়ে নেই, সাঁতার কাটছে। তাই রাইফেলের সব কটা বুলেট লক্ষ্যভেদ করল কিনা বলা মুশকিল।
তবে অন্তত একটা গুলি নিশ্চয়ই সর্পের দেহে বিদ্ধ হয়েছিল, কারণ আগ্নেয়াস্ত্রের আওয়াজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মহাসর্প নদীর জলে প্রচণ্ড আলোড়ন তুলে ছটফট করতে লাগল। আনাকোন্ডার দেহে কামড় বসিয়ে বর্শার ফলাটা এতক্ষণ দুলে দুলে উঠছিল, জলের ধাক্কায় সেই অস্ত্রটা এবার তার শরীর থেকে খসে নদীর জলে হারিয়ে গেল। পরক্ষণেই জলের তলায় অদৃশ্য হয়ে গেল মূর্তিমান আতঙ্ক! এতক্ষণ পর্যন্ত ভাসমান বর্শান্ত দেখেই শিকারিরা নদীর উপর আনাকোন্ডার অস্তিত্ব নির্ণয় করতে পেরেছে, কিন্তু বর্শাটা এখন খুলে পড়ায় জলরাশির মধ্যে তাকে আবিষ্কার করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ল।
জলের উপর কিছুটা রক্ত ভেসে উঠেছিল কিন্তু সরীসৃপ জাতীয় জীবের দেহে খুব গভীর ক্ষত হলেও ক্ষতস্থান থেকে স্তন্যপায়ী জীবের মতো প্রচুর রক্তপাত হয় না। তাই সামান্য রক্তের চিহ্ন ধরে আহত সাপটাকে অনুসরণ করা সম্ভব হল না। তীব্র স্রোতের টানে সেই রক্তের ধারাও সত্বর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।
কিন্তু শিকারিরা হতাশ হল না। তারা নদীর বুকে এদিক-ওদিক নৌকো চালিয়ে অনুসন্ধান করতে লাগল…।
আচম্বিতে নৌকোর তলায় এক দারুণ ধাক্কা! ধাক্কা মেরেছে আনাকোন্ডা। পরক্ষণেই আত্মপ্রকাশ করল সে! সঙ্গেসঙ্গে নৌকো উল্টে গেল এবং সার্জেন্ট পাবলো তার দলবল নিয়ে ছিটকে পড়ল নদীর জলে!
সবাই মিলে নৌকোটাকে আবার সোজা করে উঠে পড়ল বটে, কিন্তু অস্ত্রশস্ত্রগুলি তখন নদীর জলে অদৃশ্য হয়ে গেছে!
সুখের বিষয়, আনাকোন্ডা এই সুযোগে শিকারিদের আক্রমণ করার চেষ্টা করেনি নৌকো উলটে দিয়ে আবার জলের তলায় গা-ঢাকা দিয়েছে।
ইতিমধ্যে অকুস্থলে আবির্ভূত হয়েছে দুই নম্বর ক্যানো। এই নৌকোটা আরও বড় এবং তার ছয় জন আরোহীর মধ্যে চার জনের হাতেই রাইফেল।
দুনম্বর নৌকো থেকে পাবলো এবং তার এক জন সঙ্গীকে একটি একটি করে দুটি রাইফেল দেওয়া হল। পাবলোর নির্দেশে দুটি ক্যানো পাশাপাশি চলতে লাগল। তাদের মধ্যে দূরত্ব প্রায় কুড়ি ফিট।
আনাকোন্ডা যে দ্বিতীয়বার আক্রমণ করবে না, এমন কথা জোর করে বলা যায় না। তাই ক্যানো দুটিকে কাছাকাছি রাখার ব্যবস্থা করা হল।
বলা যায় না, মুহূর্তের অসতর্কতায় শিকারি পরিণত হতে পারে শিকারে!…।
সমস্ত সকাল ধরে চলল অনুসন্ধান। নদীর দুই দিকের তীরবর্তী অগভীর জলে বার বার খুঁজে দেখল শিকারিরা। পাবলোর বিশ্বাস, সাপটা আহত অবস্থায় গভীর জলে বেশিক্ষণ ডুবে থাকতে পারবে না, খুব সম্ভব নদীর ধারে কোনো গোপন গুহা বা গর্তের ভিতর সে লুকিয়ে আছে। পরবর্তী ঘটনায় প্রমাণ পাওয়া গেল যে, পাবলোর ধারণা ছিল সম্পূর্ণ নির্ভুল।
প্রভাত অতিবাহিত হল ব্যর্থ প্রচেষ্টায়… পলাতক আনাকোন্ডার সন্ধান মিলল না কোথাও।
তাড়াতাড়ি মধ্যাহ্ন ভোজোনের পালা সাঙ্গ করে পাবলো এবং তার দল আবার অনুসন্ধান শুরু করল। জিভরো রেড-ইন্ডিয়ানরা এতক্ষণে নদীর এপারে সাপটার সন্ধান করছে। এইবার তারা নৌকোযোগে নদীর অপর পারে উঠে খোঁজাখুঁজি করতে লাগল। আর অন্যান্যেরা দুটো ক্যানো জলে ভাসিয়ে টহল দিতে শুরু করল। তাদের লক্ষ্য নদীর অগভীর জলের দিকে..
বেলা পড়ে এসেছে। অপরাহ্ন ৪টা। হঠাৎ নদীর উত্তর দিকের তীরভূমি থেকে ভেসে এল উত্তেজিত জিভারোদের উল্লাসধ্বনি?
ক্ষিপ্রহস্তে বৈঠা চালিয়ে মাঝিরা নৌকো দুটিকে যথাস্থানে নিয়ে এল। আর পরক্ষণে শিকারিদের চোখের সামনে ভেসে উঠল এক অদ্ভুত দৃশ্য!
জিরো শিকারিরা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে একটা গর্ত বা গুহার মতো জায়গায় বর্শা দিয়ে খোঁচা মারছে। পলাতক দানব জিরো শিকারিদের তীক্ষ্ণদৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে পারে নি।
নদীর ধারে যেখানে নিমজ্জিত শিকড় ও উদ্ভিদের অরণ্যে আত্মগোপন করেছে সর্পদানব আনাকোন্ডা, সেখানে জলের গভীরতা খুব কম— চার-পাঁচ ফিটের বেশি নয়। তীরের জমিটা জলের উপর খানিকটা এগিয়ে এসে পলাতক সর্পের দেহের উপর একটা আচ্ছাদনের সৃষ্টি করেছে এবং ঘরের ছাদের মতো ওই জমির ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে কয়েক জন জিরো তাদের সুদীর্ঘ বর্শা দিয়ে নীচের অন্ধকার গুহার মতো জায়গাটায় সজোরে খোঁচা মেরে চলেছে অবিরাম।
আরও কয়েকজন জলের কিনারে উচ্চভূমির উপর দাঁড়িয়ে আছে উদ্যত বর্শা হাতে, এবং আর একদল অতি-দুঃসাহসী জিভারো শিকারি জলে নেমে ঘন সন্নিবিষ্ট উদ্ভিদের বেড়াজাল ভেঙে নদীর দিক থেকে সাপটাকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে,
হঠাৎ নদীর তীরবর্তী ছাদের মতো জমিটা ভেঙে পড়ল সশব্দে! আর–
যেখানে ঘন উদ্ভিদের জাল ও অগভীর জলের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে আনাকোন্ডা, ঠিক সেই জায়গায় অন্ধকার মাখা গুহাটার ভিতর ছিটকে পড়ল দুজন জিভারো!