আনাকোন্ডা জল ভালোবাসে। অধিকাংশ সময়েই সে জলে থাকে, তবে ক্ষুধার্ত হলে ডাঙায় উঠে এসেও শিকারকে আক্রমণ করে। অর্থাৎ এই সর্পদানবের জাত উভচর জলে স্থলে সর্বত্রই তার অবাধ গতি। দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন জলাভূমি ও নদীর নিকটবর্তী অরণ্যে এই ভয়ঙ্কর জীবদের দেখা যায়।
এমনি এই সর্পদানবের আতঙ্কে পেরু ও ইক্যয়াডরের সীমান্তভুমির দম বন্ধ হবার যোগাড় হয়েছে। আর তাই সাপটাকে হত্যা করার জন্য রাজ্য সরকারের তরফ থেকে নিযুক্ত হয়েছে একদল শিকারি।
শ্বেতাঙ্গ ও স্থানীয় অধিবাসীদের নিয়ে মিলিত এই দলটির নেতা পাবলো আগুরা নামক জনৈক সার্জেন্ট। পাবলো ও তার শ্বেতাঙ্গ সঙ্গীদের নিয়ে যে শিকারির দলটি গঠিত হয়েছে তারা সকলেই সীমান্তের রক্ষীবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত। আর জিভারো এবং ইয়াম্বো নামক রেড-ইন্ডিয়ান জাতির দুই দল মানুষ স্বেচ্ছায় যোগ দিয়েছে এই শিকার-অভিযানে।
পাবলোর নেতৃত্বে শ্বেতাঙ্গ সৈনিক ও রেড-ইন্ডিয়ানদের মিলিত বাহিনী সমগ্র অঞ্চলটা খুঁজল তন্ন-তন্ন করে। কিন্তু সর্পদানবের সন্ধান মিলল না।
পাবলো তখন সাপের জন্যে ফাঁদ পাতল। এই ফাঁদের টোপ হল কয়েকটা ছাগল। নদীর ধারে বিভিন্ন জায়গায় কয়েকটা ছাগলকে বেঁধে রাখা হল। এই জীবন্ত টোপগুলির আশেপাশে সর্পরাজকে উপযুক্ত অভ্যর্থনা করার জন্য লুকিয়ে রইল একদল সশস্ত্র শিকারি। দ্বিপদ ও চতুষ্পদ যাবতীয় জীবন্ত খাদ্যের মধ্যে ছাগলই হচ্ছে আনাকোন্ডার সবচেয়ে প্রিয় খাদ্য। অতএব শিকারিরা আশা করে, ছাগ-মাংসের লোভে দানব নিশ্চয় আত্মপ্রকাশ করবে…
পর পর তিনটি দিন চলে গেল, কিন্তু আনাকোন্ডার পাত্তা নেই! হয়তো সর্পরাজ শিকারিদের অভিসন্ধি বুঝতে পেরেছে, অথবা তখনো পর্যন্ত হয়তো পূর্ববর্তী শিকারের মাংসে উদর পূর্ণ থাকায় সরীসৃপ নতুন শিকারের প্রতি আকৃষ্ট হয়নি।
অবশেষে চতুর্থ দিন ভোর সাড়ে পাঁচটার সময় হঠাৎ প্রভাতের নীরবতা ভঙ্গ করে জাগল একটা ছাগল কণ্ঠের কাতর আর্তনাদ!
আরাবেলা নামক একটি ছোট জলধার যেখানে কুরারে নদীর বিপুল জলস্রোতের সঙ্গে মিলিত হয়েছে, তার নীকটবর্তী তীরভূমির উপর থেকেই শব্দটা ভেসে আসছে। ওই অঞ্চল পাহারা দেওয়ার ভার নিয়েছে তিন জন ইয়াম্বো-জাতীয় রেড-ইন্ডিয়ান এবং একজন শ্বেতাঙ্গ সৈনিক। তারা শব্দ লক্ষ্য করে ছুটল।
আকুস্থলে সর্বপ্রথম যে রেড-ইন্ডিয়ানটি পদার্পণ করল, তার চোখের সামনে ভেসে উঠল এক ভয়ংকর দৃশ্য আনাকোন্ডার প্রচণ্ড আলিঙ্গনের মধ্যে নিশ্চল হয়ে আছে হতভাগ্য ছাগলের প্রাণহীন দেহ! আক্রান্ত হয়ে একবারই আর্তনাদ করার সময় পেয়েছিল জীবটি পর মুহূর্তে নাগপাশের নিষ্ঠুর বন্ধন তার কণ্ঠকে নীরব করে দিয়েছে। মৃত্যু এসেছে মুহূর্তের মধ্যে!
ইয়াম্বো শিকারিটি অকুস্থলে এসে পৌঁছোনোর আগে সাপটা নিশ্চয়ই তার শিকার নিয়ে জলের ভিতর আত্মগোপন করত। কিন্তু জলস্রোতের নিকটবর্তী তীরভূমির উপর অবস্থিত একটা গাছের সঙ্গে শক্ত দড়ি দিয়ে ছাগলটা বাঁধা ছিল বলেই সর্পরাজের উদ্দেশ্য সফল হয় নি। ইয়াম্বো রেড-ইন্ডিয়ানটি দেখল আনাকোন্ডা দড়ি ছিঁড়ে শিকার নিয়ে নদীর বুকে ঝাঁপ দেওয়ার চেষ্টা করছে।
এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে রেড-ইন্ডিয়ানটি তার হাতের বর্শা নিক্ষেপ করল। সাপের মোটা চামড়া ভেদ করে বসে গেল বর্শার শাণিত ফলক। ইতিমধ্যেই লোকটির চিৎকার শুনে তার সঙ্গীরা যথাস্থানে এসে পড়েছে এবং আনাকোন্ডাও বুঝতে পেরেছে, এই জায়গাটা আর তার পক্ষে নিরাপদ নয়।
ছাগমাংসের মায়া ছেড়ে সে তখুনি দ্রুতবেগে এগিয়ে গেল জলের দিকে।
একজন শ্বেতাঙ্গ সৈনিকের রাইফেল উপরি-উপরি দুবার গর্জে উঠল। দুজন রেড়-ইন্ডিয়ান শিকারির হাতের বর্শা ছুটে গেল আনাকোন্ডার দেহ লক্ষ্য করে গুলি লাগল কিনা বোঝা গেল না, কারণ সর্পদানবের গতি রুদ্ধ হয়নি এক মুহূর্তের জন্যও। আর বর্শা দুটিও হল লক্ষ্যভ্রষ্ট…
ঘটনাটা যেখানে ঘটছে, সেই জায়গা থেকে সিকি মাইল দূরে ছিল সার্জেন্ট পাবলোর আস্তানা। রাইফেলের গর্জন শুনেই সে বুঝল, কিছু একটা হয়েছে। তাড়াতাড়ি শয্যা ত্যাগ করে উপযুক্ত পোশাক চড়িয়ে সে যখন অকুস্থলে উপস্থিত হল, তখন আনাকোন্ডা জলের তলায় আত্মগোপন করেছে।
যে সৈন্যটি গুলি চালিয়েছিল, সে পাবলোকে জানাল যে, এত লম্বা আর এত মোটা সাপ দেখে সে হয়ে পড়েছিল হতভম্ব। তার উপর দু-দুটো গুলিতেও যখন সাপটার কিছু হল না, তখন তার এমন বুদ্ধিভ্রংশ ঘটল যে, তৃতীয়বার গুলি ছোঁড়ার কথা মনেই হয়নি। একটু পরেই অবশ্য তার সম্বিৎ ফিরে আসে। এবং তার সহযোগী রেড-ইন্ডিয়ানদের ডেকে সে একটা ক্যানো-জাতীয় নৌকো আনতে বলে
পাবলোর সহকারী রেড-ইন্ডিয়ান শিকারিরা যখন অকুস্থলে এসে উপস্থিত হল, তখন পূর্বোক্ত শ্বেতাঙ্গ সৈনিকের সঙ্গীরা নৌকো নিয়ে এসেছে। দুজন সুদক্ষ সৈনিকের সঙ্গে নৌকোর উপর উঠে বসল সার্জেন্ট পাবলো। নৌকো চালানোর ভার নিল দুজন ইয়াম্বো-জাতীয় রেড-ইন্ডিয়ান। জিভায়রা-জাতীয় রেড-ইন্ডিয়ানরা ডাঙার উপর পা চালিয়ে নৌকোটাকে অনুসরণ করল এবং পাবলোর আদেশে তার অধীনস্থ সৈনিকরা আর একটি নৌকো আনতে ছুটল।
সকাল ছটা বেজে গেছে। নদীর মধ্যস্থল এখন দিবালোকের স্পর্শে উজ্জ্বল, অবশ্য তীরের কাছে ঘন উদ্ভিদের ছায়ায় ঢাকা অন্ধকারের নীড় ভাঙতে তখনও আধঘণ্টা দেরি…