বাঁচা গেল।
বি আর জেরা করলে না। সে বুঝল, যেভাবেই হোক গুন্ডাটা সমুদ্রগর্ভে সমাধিলাভ করেছে। সে দরজা খুলে বাইরে এসে জাহাজের ডেকের ওপর দাঁড়াল।
এক্স জাহাজ সেযাত্রা বেঁচে গেল।
বি-র নির্দেশ অনুযায়ী প্রাণপণে ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে মাল্লারা জাহাজটাকে রক্ষা করলে ক্ষিপ্ত সমুদ্রের গ্রাস থেকে।
জাহাজ নিরাপদে পৌঁছে গেল তার নিজস্ব বন্দরে।
সর্দার-খালাসি ম-কে গ্রেপ্তার করে বিচারকের সামনে উপস্থিত করা হল। তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সৃষ্টির অভিযোগ।
বিচারে অবশ্য তার শাস্তি হয়নি, উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করা গেল না। বিচারক তাকে ছেড়ে দিলেন।
তবে আদালতের দরবারে শাস্তি না-পেলেও বির হাতে যথেষ্ট নিগ্রহ এবং অপমান ভোগ করেছিল ম।
সবজান্তা মানুষটির মানসপটে শুষ্ক ক্ষতচিহ্নের মতো চিরকাল জেগে থাকবে সেই লাঞ্ছনার ইতিহাস।
[বৈশাখ ১৩৭৭]
সীমান্তের বিভীষিকা
রাজ্য সরকার চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।
চিন্তার কথা তো বটেই। কিছুদিন ধরে সীমান্তের সেনানিবাসে চিঠিপত্র বা খাদ্যবস্তু কিছুই এসে পৌঁছোয় না–ডাকপিয়ন নিরুদ্দেশ!
দক্ষিণ আমেরিকার যে বিস্তীর্ণ অরণ্যভূমির বুকে পেরু এবং ইক্যয়াডর নামক দুই রাজ্যের সীমানা এসে মিলিত হয়েছে, সেইখানে ইক্যয়াডার রাজ্যের নিজস্ব সীমান্তে একটি ছোটো সেনানিবাস আছে।
সেনানিবাসের খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা নিয়েই ইক্যয়াডরের রাজ্য সরকার খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।
চিন্তার কারণ আগেই বলেছি- শহর থেকে চিঠিপত্র ও খাদ্যবস্তু নিয়ে ডাকবাহক আর সেনানিবাসে পদার্পণ করে না। চিঠিপত্র তবু না হলেও চলে, কিন্তু খাদ্যের অভাবে সীমান্তরক্ষীদের অবস্থা শোচনীয়।
শুরু হল অনুসন্ধান-পর্ব। অবশেষে জানা গেল যে, হতভাগ্য ডাকপিয়নের অনুপস্থিতির কারণ হচ্ছে একটি অতিকায় সর্প।
এক জন নয়, পর পর দুজন ডাকহরকরা সাপের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছে। আপার আমাজন নামক অরণ্যময় অঞ্চলের ভিতর দিয়ে নদীপথে নৌকো চালিয়ে আসার সময় সর্পদানব নৌকোর উপর হানা দিয়ে ডাকবাহকদের হত্যা করেছে এবং নৌকোসমেত যাবতীয় খাদ্যবস্তুর হয়েছে সলিল-সমাধি।
মহা মুশকিল! সাপের উৎপাতে কি সীমান্তরক্ষী সৈন্যরা উপবাস করবে?
বিমানযোগে প্যারাশুটের সাহায্যে কিছু কিছু খাদ্যদ্রব্য সৈন্যদের প্রেরণ করা হয় বটে, কিন্তু কয়েকটি বিশেষ প্রয়োজনীয় খাদ্য ওইভাবে পাঠানো সম্ভব নয়। তাই জলপথে নৌকো চালিয়ে চিঠির সঙ্গে খাদ্যসম্ভারও নিয়ে আসে ডাকবাহক পিয়ন।
পান্তাজা, টাইগার ও কুরারে নামক তিনটি নদীর উপর দিয়ে ক্যানো জাতীয় নৌকোর সাহয্যে ডাকবিভাগের কাজকর্ম চালানো হয়। ইক্যয়াডর রাজ্যের ডাকবহনকারী পিয়নরা সভ্য জগতের সঙ্গে অরণ্যবাসী সৈনিকদের আদান-প্রদান অক্ষুণ্ণ রাখে। অতএব তাদের জীবন রাষ্ট্রের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান।
পর পর তিনটি নৌকো এবং দু-দুটি পিয়ন যখন সর্পের আক্রমণে সলিল সমাধি লাভ করল, তখন রাজ্য সরকার উদবিগ্ন হয়ে পড়লেন। সাপটাকে হত্যা করার জন্য নিযুক্ত হল একটি শিকারি দল।
সীমান্তরক্ষী কয়েক জন শ্বেতাঙ্গ সৈনিক ও অরণ্যবাসী রেড-ইন্ডিয়ানদের নিয়ে এই ছোটো দলটি গঠিত হল। দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন সার্জেন্ট পাবলো।
গ্রামবাসীদের মধ্যে অনুসন্ধান করে ইতিমধ্যে জানা গেছে, সর্পদানব শুধু ডাকহকরাদের মৃত্যুর জন্য দায়ী নয়, তার ভয়াবহ ক্ষুধা তৃপ্ত করতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে কয়েকটি শিশু এবং তিনটি যুবক।
নদীর জলে সাঁতার কাটার সময়ে যুবক তিনটি সর্পদানবের আক্রমণে মারা পড়েছে। হত্যাকাণ্ডগুলি সংঘটিত হয়েছে বহু মানুষের চোখের সামনে।
নদীর জলে রেড-ইন্ডিয়ান মেয়েরা ময়লা কাপড়-চোপড় পরিষ্কার করে। কোনো অসতর্ক জননী যদি শিশু-সন্তানকে তীরভূমির উপর রেখে কাপড় কাঁচতে বসে, তাহলেই হয় বিপদ। আচম্বিতে জলের ভিতর থেকে একটা সুদীর্ঘ লাঙ্গুল ছিটকে বেরিয়ে আসে, পরক্ষণে ডাঙার উপর অবস্থিত হতভাগ্য শিশুটিকে জড়িয়ে ধরে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে জলের মধ্যে!
শিকারের দেহ জলের উপর এসে পড়লেই ভয়াল দানব তাকে কামড়ে ধরে। অভাগিনী মা দেখতে পায়, তার কোলের সন্তান ছটফট করছে সাপের মুখে। পরক্ষণেই নদীর জলে মিলিয়ে যায় সেই ভয়াবহ দৃশ্য।
শুধু দ্বিপদ মনুষ্য নয়, গৃহপালিত চতুষ্পদ পশুর প্রতিও আকৃষ্ট হয়েছে মহাসর্পের লুব্ধ দৃষ্টি। গ্রামবাসীদের বহু কুকুর, ছাগল ও শূকর স্থান লাভ করছে সর্পের উদর-গহ্বরে।
এতগুলো হত্যাকাণ্ডের নায়ক হচ্ছে একটি আনাকোন্ডা।
সর্পরাজ আনাকোন্ডা– যেমন ভয়ঙ্কর তার চেহারা, তেমনি তার আকৃতি-প্রকৃতি! অজগর সমাজে আনাকোন্ডা হচ্ছে বৃহত্তম জীব। এরা দৈর্ঘ্যে আঠারো থেকে পঁচিশ ফিট পর্যন্ত হয়। পঁয়ত্রিশ ফিট লম্বা আনাকোন্ডাও দেখা গিয়েছে।
অজগর-গোষ্ঠীর অন্যান্য সাপের মতোই আনাকোন্ডা নির্বিষ। অবশ্য তাতে কিছু যায়-আসে না। শিকারকে অতর্কিতে জড়িয়ে ধরে চাপ দিতে থাকে আনাকোন্ডা এবং সেই প্রচণ্ড পেষণে অস্থি-পঞ্জর চূর্ণ হয়ে অথবা শ্বাসরোধ ঘটার ফলে হতভাগ্য জীবটি যখন প্রাণত্যাগ করে, তখন সর্পরাজ শিকারের মৃতদেহ আস্ত গিলে ফেলে। এক বার শিকার ধরলে বেশ কয়েক দিন তার আর আহারের প্রয়োজন হয় না। এই সময় নির্জীব হয়ে শুয়ে থাকে সে। শিকারের দেহের মাংস হজম হয়ে গেলেই আবার শিকারের সন্ধানে বের হয়।