বি তার চওড়া কাঁধ দুটো ঝাঁকিয়ে বললে, বেশ, তোমরা যা খুশি করো। তবে একটা কথা জেনে রাখো, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা ম-র হাতে হাতকড়া না-লাগাবে ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা কেউ তামাক কিংবা সিগারেট পাবে না। আমার আদেশ পালন না-করলে ধূমপান বন্ধ, বুঝলে?
বি তার নিজের কেবিনে ফিরে এল।
তিন দিনের মধ্যেই অবস্থা গুরুতর হয়ে পড়ল।
বি-র সহকারী শিক্ষানবিশ ছেলেটিকে সবাই মিলে এমন প্রহার করল যে ছেলেটি জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।
খবর পেয়ে লাফিয়ে উঠল বি, শয়তানগুলোকে ভালোভাবে শিক্ষা দিতে হবে।
বি সোজা এসে ঢুকল ভাড়ার ঘরে।
একটু দূরেই দাঁড়িয়েছিল বিদ্রোহী মাল্লার দল, তাদের মধ্যে একজন প্রশ্ন করলে, কী করতে চাও মিস্টার?
বলছি, একটু অপেক্ষা করো। জাহাজের রাঁধুনিকে ভঁড়ার ঘর থেকে বাইরে এনে দরজায় তালা লাগিয়ে দিলে বি, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা ম-র হাতে হাতকড়া না-লাগাবে ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের খাওয়াদাওয়া বন্ধ। ভঁড়ার ঘর আর রান্নাঘর আমি তালা লাগিয়ে বন্ধ করে দিলুম।
সমবেত জনতার কণ্ঠে জাগল হিংস্র গর্জন-ধ্বনি।
সাঁ করে উড়ে এসে একটা কাঠের ডান্ডা বি-র মাথা ঘেঁষে দরজার উপর সশব্দে আছড়ে পড়ল, একটুর জন্য সে বেঁচে গেল।
বিনা বাক্যব্যয়ে পকেট থেকে রিভলভার বার করলে বি।
রিভলভার দেখে বিদ্রোহী নাবিকদের আক্কেলগুড়ুম হয়ে গেল। চটপট পা চালিয়ে তারা সরে পড়ল বির সামনে থেকে।বি-র ওষ্ঠাধরে জাগল তিক্ত হাসির রেখা, গরম গরম গুলি খেতে বোধ হয় তোমাদের ভালো লাগবে না, কি বলো?
তারপর পিছন ফিরে সে অকুস্থল ত্যাগ করলে।
তার সঙ্গ নিলে দুজন সহকারী।
সেদিন সন্ধ্যার পরেই আকাশের অবস্থা হয়ে উঠল শোচনীয়। ঘন মেঘের কালো ছায়া হানা দিল আকাশের গায়ে, অন্ধকার শূন্যে বিদ্যুৎ ছড়িয়ে হেঁকে উঠল বজ্র–গর্জিত বাতাসের সঙ্গে নাচতে নাচতে নেমে এল প্রবল বৃষ্টিধারা।
খালাসিরা কিন্তু কেউ জাহাজ রক্ষা করতে এগিয়ে এল না।বি তার দুই সহকারীর সাহায্যে পালগুলো নামিয়ে রাখার চেষ্টা করতে লাগল।
আচম্বিতে ছুটে এল কয়েকটা কাঠের ডান্ডা বি-র দিকে। একটা ডান্ডা বি-র পেটে লাগতেই তার হাত থেকে রিভলভারটা ছিটকে পড়ল। তৎক্ষণাৎ অন্ধকারের ভিতর থেকে ছুটে এসে ম রিভলভারটা তুলে নিয়ে বি-র দেহ লক্ষ করে গুলি ছুড়ল। নিশানা ব্যর্থ হল, বি লম্বা দৌড় মারল তার কেবিনের দিকে। তার পিছনে তাড়া করে ছুটে এল ক্ষিপ্ত মাল্লার দল।
বি-র দুই সহকারী এবার রঙ্গমঞ্চে ভূমিকা গ্রহণ করলে।
একজন এগিয়ে এসে জনতাকে লক্ষ করে রিভলভার ছুড়ল। একটা কাতর আর্তনাদ ভেসে এসে জানিয়ে দিল রিভলভারের গুলি লক্ষ্য ভেদ করেছে।
হঠাৎ অন্ধকারের বুকে বিদ্যুৎ হেনে উড়ে এল একটা মস্ত ছোরা। চিৎকার করে উঠল বি-র একজন সহকারী ছোরাটা তার কাঁধের ওপর বসে গেছে।
আহত ছেলেটির অবশ হাত থেকে রিভলভারটা টেনে নিয়ে বি দু-বার গুলি চালাল। জাহাজের অন্ধকার গহ্বর থেকে কাতর আর্তস্বর জেগে উঠে জানিয়ে দিলে গুলি যথাস্থানে পৌঁছে গেছে।
মাঝিমাল্লারা খেপে গেল। অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে তারা ছুঁড়তে লাগল ঝাঁকে ঝাকে কাঠের ডান্ডা আর লোহার টুকরো।
বি তার দুই সহকারীকে সঙ্গে নিয়ে চার্টরুম-এর ভিতর ঢুকে দরজায় ভিতর থেকে তালা লাগিয়ে দিলে।
বন্ধ দরজার ওপর পড়তে লাগল আঘাতের পর আঘাত, কিন্তু ওক কাঠের শক্ত দরজা অত সহজে ভাঙা সম্ভব নয়।
ইতিমধ্যে নূতন বিপদের সূত্রপাত।
জাহাজের ওপর আছড়ে পড়ছে ক্ষিপ্ত ঝটিকা এবং তার তলদেশে আঘাত হেনে লাফিয়ে উঠছে তরঙ্গ-বন্ধুর উত্তাল সমুদ্র।
চালকবিহীন জাহাজের তখন যায় যায় অবস্থা, এখনই বুঝি ভরাডুবি হয়।
বিপদের গুরুত্ব বুঝে মাল্লারা লড়াই থামিয়ে জাহাজ বাঁচাতে ছুটল।
কিছুক্ষণ পরেই আবার করাঘাতের শব্দ বেজে উঠল বন্ধ দরজার গায়ে, একজন নাবিক আর্তস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, মি. বি–দরজা খোলো। জাহাজ প্রায় ডুবতে বসেছে। তুমি তাড়াতাড়ি এসো।
উদ্যত রিভলভার হাতে বি দরজা খুলল।
জলসিক্ত দেহে নাবিকটি চেঁচিয়ে উঠল, তাড়াতাড়ি এসো, জাহাজ ডুবছে!
বাইরে বৃষ্টি পড়ছে মুষলধারে!
বি শান্তস্বরে বললে, আমি কী করব? তোমাদের সর্দারের কাছে যাও।
সে হতভাগা জাহাজ চালাতে জানে না। এতক্ষণ ধরে সে উলটোপালটা হুকুম চালিয়ে জাহাজটাকে ডোবাতে বসেছে। তুমি ছাড়া কেউ এখন জাহাজ বাঁচাতে পারবে না–তাড়াতাড়ি চলো।
বি-র প্রধান সহকারী এগিয়ে এল, কিন্তু বি বাধা দিলে, না। আগে এই লোহার বালা দুটো নিয়ে যাও
টেবিলের টানা খুলে বি একজোড়া হাতকড়া তুলে ধরলে ওই হতভাগা ম আর ছুরিমারা গুন্ডা মূলাটোকে আগে বন্দি করে নিয়ে এসো। আমার আদেশ পালিত না হলে আমি জাহাজের ভার গ্রহণ করব না।
একটানে হাতকড়া দুটো ছিনিয়ে নিয়ে নাবিকটি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে বেরিয়ে গেল।
একটু পরেই একদল নাবিক ঘরে প্রবেশ করলে, তাদের সঙ্গে রয়েছে ম! তার দুই হাতে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে হাতকড়া।
বি বললে, আর একজন কোথায়? ওই মূলাটো গুন্ডা–তার কী হল?
একজন নাবিক বললে, পাজিটা ছুরি বার করেছিল স্যার।
হু, তারপর?
ইয়ে, মানে… ছুরিটা নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম আমরা… মানে… ইয়ে..
বি ধমক দিলে, স্পষ্ট করে বলো কী বলতে চাও?
ইয়ে, মানে–ঝটাপটি করতে করতে মূলাটোটা হঠাৎ কেমন করে জলে পড়ে গেল।