ক্যাপ্টেন তো আগেই মারা গিয়েছিলেন, এখন জাহাজ পরিচালনার ভার নেয় কে?
বি নিজেই এবার পোত-অধ্যক্ষ বা ক্যাপ্টেনের স্থান অধিকার করলে। জাহাজের ভাঙাচোরা অংশগুলি মেরামত করে সে নাবিকদের ডাকল। সমবেত মাঝি-মাল্লাদের উদ্দেশ্য করে সে জানিয়ে দিলে, যদিও পূর্বনির্ধারিত ব্যবস্থা অনুযায়ী জাহাজের গন্তব্যস্থল ছিল পাগেট সাউন্ড নামক স্থান, কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন হওয়ায় এক্স জাহাজ এখন সেখানে যাবে না।
জাহাজ যেখান থেকে সাগরে ভেসেছিল আবার সেই বন্দরেই ফিরে যাবে, অর্থাৎ জাহাজের গন্তব্যস্থল এখন পাগেট সাউন্ড নয়–লিভারপুল।
ম হঠাৎ প্রতিবাদ জানিয়ে বললে, মেট-এর সিদ্ধান্ত তার মনঃপূত নয় এবং বি যদি তার সঙ্গীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তাহলে সে বুঝবে নাবিকরা কেউ তাকে সমর্থন করছে না।
বি বললে, কারো মতামত জানতে সে এখানে নাবিকদের ডাকেনি।
তার মতামত জানানোর জন্যই সে সকলকে ডেকে পাঠিয়েছিল।
নাবিকদের ভিতর থেকে একটা মূলাটো জাতীয় বর্ণসংকর উঠে দাঁড়িয়ে বি-কে জানাল যে সে ম-র সঙ্গে একমত। জাহাজ চালানোর অভিজ্ঞতা বি-র নেই, অতএব পরিচালনার ভার ম-কে দেওয়া উচিত।
খোঁচা খাওয়া বাঘের মতো ঘুরে দাঁড়াল বি, বাঃ! ক্যাপ্টেনের মৃত্যুর জন্য তুমিই তো দায়ী, এখন আবার লম্বা বক্তৃতা ঝাড়ছ?
সমবেত নাবিকমণ্ডলী চমকে উঠল–এ আবার কী কথা?
বি আবার বললে, ভেবেছিলুম কিছু বলব না। কিন্তু তুমি যখন মুখ খুলেছ তখন সত্যি কথাটা সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছি। জাহাজের চাকা ঘোরানোর ভার ছিল তোমার ওপর–ক্যাপ্টেন দাঁড়িয়ে ছিলেন তোমার পাশে। তুমি যদি চাকা ছেড়ে ভয়ে পালিয়ে না যেতে তাহলে হয়তো ক্যাপ্টেনের মৃত্যু হত না। ভীরু! কাপুরুষ! নিজে দোষ করে আবার বড়ো বড়ো কথা কইতে লজ্জা করে না! হ্যাঁ, তোমার সঙ্গীদের একটা কথা জানিয়ে দেওয়া দরকার–এখন থেকে তুমি দ্বিতীয় শ্রেণির নাবিক, প্রথম শ্রেণির থেকে তোমাকে আমি খারিজ করলুম। এখন তুমি অনেক কম টাকা পাবে আর বন্দরে পৌঁছেই তোমার নামে আমি নালিশ জানাব।
মূলাটো গজগজ করতে করতে চলে গেল।
বি-র সহকারী ব্যাপারটা পছন্দ করলে না।
বর্ণসংকর মূলাটোটা পাকা গুন্ডা, ইতিপূর্বে একটি লোককে সে ছোরা মেরেছিল।
বি অবশ্য এই ধরনের লোককে পরোয়া করে না।
ছোরাছুরির ভয়ে নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার মত মেরুদণ্ডহীন মানুষ সে নয়।
কিছুদিন পরে হল আর একটি দুর্ঘটনার সূত্রপাত।
একজন নাবিক হঠাৎ ডেকের ওপর থেকে সমুদ্রের জলে পড়ে গেল। তাকে উদ্ধার করার জন্য নৌকা নামাতে গিয়ে নাবিকরা দেখল, নোঙর তোলার জন্য যে কাষ্ঠ-আধারটা ব্যবহার করা হয় সেটা যথাস্থানে নেই। কোনোরকমে ব্যবস্থা করে লোকটাকে সলিলসমাধি থেকে উদ্ধার করা হল বটে কিন্তু বেশ দেরি হয়ে গেল। ইতিমধ্যে হিংস্র সামুদ্রিক পক্ষীর আক্রমণে লোকটির হাত এবং মুখ হয়ে গেছে ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত।
ম বললে, যে লোকটি জলে পড়েছিল তার দুর্দশার জন্য দায়ী বি, কারণ তার আদেশেই ওই নোঙরগুলো খুলে ফেলা হয়েছিল। শুধু ওইটুকু বলে সে চুপ করলে না, তার আশেপাশে সমবেত নাবিক-বন্ধুদের সে বোঝাতে লাগল যে বি মোটেই অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করার উপযুক্ত নয়।
ম-র বক্তব্যের মধ্যে যুক্তির অভাব থাকলেও বিদ্রুপের অভাব ছিল না কিছুমাত্র।
বি একটু দূরে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল।ম-রউচ্চকণ্ঠের মন্তব্যগুলি খুব সহজেই তার শ্রবণপথে প্রবেশ করছিল। সে বুঝল, নাবিকদের উপলক্ষ্য করে ম কথাগুলো তাকেই শোনাতে চাইছে।
বি সামনে এসে ম-কে সম্বোধন করে বললে, শোনো ম, আজ থেকে তুমি আর খালাসিদের সর্দার নও। তোমাকে আমি সর্দারের পদ থেকে খারিজ করে সাধারণ মাল্লার পদে বহাল করলুম। তোমার মাইনেও কমে গেল।
ম-র মুখ রাগে লাল হয়ে উঠল, দুই হাতের মুঠি পাকিয়ে সে চেঁচিয়ে উঠল, আমার কাজ আমি জানি। তুমি আমাকে খারিজ করবার কে? তোমার হুকুম আমি মানতে রাজি নই।
বি-র কণ্ঠস্বরেও জাগল রোষের আভাস, আমার কথা না-শুনলে তোমার হাতে আমি হাতকড়া লাগাব।
সত্যি? হা-হা শব্দে হেসে উঠল ম, একবার চেষ্টা করে দেখো।
বি-র আদেশে তার সহকারী একটা হাতকড়া নিয়ে এল কেবিন থেকে।
একজন মাল্লা হঠাৎ বলে উঠল, ওহে মিস্টার! ম-র সঙ্গে বেশি চালাকি করার চেষ্টা করলে তোমাকে আমরা ছেড়ে দেব না।
বাঃ! বাঃ! ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল সেই বর্ণসংকর মূলাটো, চমৎকার! চমৎকার! ভাইসব–আমরা থাকতে ওই খোকাটা আমাদের সর্দারকে অপমান করবে? ডান্ডাগুলো একবার নিয়ে এসো দেখি, বুড়ো খোকাকে ঠান্ডা করার দাওয়াই আমি বাতলে দিচ্ছি।
সাবধান! গর্জে উঠল বি, সাঁৎ করে পকেট থেকে সে টেনে আনল একটা চকচকে রিভলভার, তোমাকে গুলি করে মারলে আমার কোনো শাস্তি হবে না। আইন আমার পক্ষে, সমুদ্রের বুকে জাহাজের ওপর বিদ্রোহের চেষ্টা আইনের চোখে গুরুতর অপরাধ। বিদ্রোহীকে ঊর্ধ্বতন কর্মচারীর গুলি করার অধিকার আছে। অতএব সাবধান!
সত্যি কথা। মুলাটোর উচ্চকণ্ঠ তৎক্ষণাৎ নীরব হল।
বি-র সহকারী ততক্ষণে হাতকড়া নিয়ে এসেছে।
হাতকড়াটা সহকারীর হাত থেকে নিয়ে বি সেটাকে ডেকের ওপর ছুঁড়ে দিলে, নাও, এবার ওই হতভাগা মর হাতে তোমরা লোহার বালা পরিয়ে দাও চটপট।
সামনে এগিয়ে এল এক জোয়ান খালাসি, বি-র চোখের ওপর চোখ রেখে সে বললে, হ্যাঁ, চটপট করছি। পরক্ষণেই এক লাথি মেরে সে হাতকড়াটাকে পাঠিয়ে দিলে জাহাজের নর্দমার মধ্যে! প্রকাশ্য বিদ্রোহ!